আল আমিন হোসাইন: প্রযুক্তির এ যুগে আমাদের জীবনযাত্রা সহজ থেকে সহজতর করতে বহু পণ্য উদ্ভাবিত হচ্ছে। প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতিতে আকর্ষণীয় ডিজাইন ও আয়েশি জীবন-যাপনের প্রতি আকর্ষণে মানুষ নতুন নতুন পণ্য গ্রহণ করছে। ফলে এসব পণ্য অচল হলেই ই-বর্জ্যে পরিণত হচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে ।
ইলেকট্রনিক বর্জ্য বা ই-বর্জ্য বলতে পরিত্যক্ত বৈদ্যুতিক বা ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম বা যন্ত্রপাতিকে বোঝায়। ই-বর্জ্যকে একেক দেশ একেকভাবে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রে ইলেকট্রনিক্স টিভি, কম্পিউটার প্রভৃতি পণ্যকে আর ইউরোপে ব্যাটারি, টিভি ও ফ্রিজ সম্বলিত সব ইলেকট্রিক দ্রব্যকে ই-বর্জ্য বলে। বৈশ্বিক ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক কনফারেন্সে ই-বর্জ্যকে মানব স্বাস্থ্যের জন্য নতুন এবং বর্ধনশীল পরিবেশগত হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইউরোপীয় দেশগুলোতে মাথাপিছু ই-বর্জ্য উৎপাদনের পরিমাণ যেমন বেশি, তেমনি মাথাপিছু ই-বর্জ্য সংগ্রহের পরিমাণও বেশি। বৈশ্বিক ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় শীর্ষ দেশ যুক্তরাষ্ট্র। উন্নত দেশগুলো ই-বর্জ্য নির্দিষ্টভাবে সংরক্ষণ ও রিসাইক্লিংয়ের জন্য উন্নত প্রযুক্তির কারখানা স্থাপন করেছে।
শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বেই বাড়ছে ই-বর্জ্যের পরিমাণ। ২০২৪ সালে এক বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে সারা বিশ্বে ৬২ মিলিয়ন টন ই-বর্জ্য তৈরি হয়েছে, যেটি পরিবহন করতে প্রায় সোয়া কোটি সংখ্যক ট্রাকের প্রয়োজন হবে। আর এসবই-বর্জ্যের এক-তৃতীয়াংশই উৎপন্ন হয় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে।
ই-বর্জ্য রপ্তানি : যুক্তরাষ্ট্র ই-বর্জ্যের প্রতি বছর ৮০শতাংশ রপ্তানি করে। ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং করা বেশ জটিল ও ব্যয়বহুল। তাই পরিবেশ বিষয়ে কম সচেতন ও আইন প্রণয়নে পিছিয়ে থাকা দেশে এসব ই-বর্জ্য প্রেরণ করে যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ই-বর্জ্যের সিংহ ভাগ উৎপন্ন হয় ইউরোপ ও আমেরিকায়, কিন্তু ৯০ শতাংশ রপ্তানি করা হয় এশিয়া ও আফ্রিকায়।
বিশ্বের বৃহত্তম ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং কেন্দ্র গড়ে উঠেছে চীনে। বিপুল পরিমাণ অব্যবহƒত পণ্যের কারণে পৃথিবীতে ই-বর্জ্য দূষণ সৃষ্টি হচ্ছে। বিশ্বে এটি পরিবেশের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । ই-বর্জ্যের মাধ্যমে ভূ-পৃষ্ঠস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানির উৎস দূষণের মাধ্যমে সুপেয় পানির প্রাপ্যতাকে গভীরে চলে যাচ্ছে। উপাদানগুলোর প্রভাবে উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বংশবিস্তার বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং বাস্তুতন্ত্রের খাদ্য শৃঙ্খল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ই-বর্জ্যের রিসাইক্লিং এ জড়িত শিশু শ্রমিকদের ৮০ শতাংশ ‘লেড’-এর ক্ষতিকর দূষণে বিপর্যস্ত।
ই-বর্জ্যের ব্যবহার : ই-বর্জ্যের ক্ষতিকর উপাদানের সঙ্গে কিছু মূল্যবান উপাদানও থাকে। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ই-বর্জ্যের ক্ষতি যেমন কমানো যায়, তেমনি মূল্যবান উপাদানগুলোও সংগ্রহ করা যায়। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি ও জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে বলা হয় বিশ্বে ইলেকট্রনিক্স পণ্যের জন্য বিশেষভাবে ব্যবহƒত ধাতুর আর্থিক মূল্য ৪৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সঠিকভাবে রিসাইক্লিং করতে পারলে ই-বর্জ্য থেকে প্রতি বছর মিলিয়ন টন মূল্যবান ধাতব সামগ্রী উদ্ধার করা সম্ভব।
ইলেকট্রনিক্স ক্ষেত্রে তামার চাহিদা খুব বেশি। তাই এসব ই-বর্জ্য রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে তামা উৎপাদন সম্ভব এবং এ তামার মাধ্যমে বায়ু শক্তি প্ল্যান্ট নির্মাণ করা যায়। ই-বর্জ্যের প্রবাহ : বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন হিসাব অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১৯ কোটি ১৩ লাখ। অর্থাৎ বলা যায় দেশের প্রতিটি মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। বছরে মোবাইল এর ২০ থেকে ২৫ শতাংশের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। প্রতিবছর দেশে সৃষ্টি হচ্ছে ৩০ লাখ মেট্রিক টন ই-বর্জ্য। মুঠোফোন থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে সর্বোচ্চ সাড়ে ১০ লাখ টন ই-বর্জ্য। কেবল অন্তত ২ লাখ ৯৬ হাজার ৩০২টি নষ্ট টেলিভিশন থেকে সৃষ্টি হচ্ছে ১ লাখ ৭০ হাজার টনের মতো ই-বর্জ্য। আর অন্যান্য ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির ব্যবহার দ্রুতই বাড়ছে, যার প্রায় ৩০ শতাংশ ই-বর্জ্যে রূপান্তরিত হয়। ২০২৫ সাল নাগাদ কোটি টনের ই-বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হবে বাংলাদেশ। যা ২০৩৫ সালে ৪৬ লাখ টনে উন্নীত হবে। বাকি ৯৭ শতাংশের ঠাঁই হয় দেশের নদী-নালা ও ভাগাড়গুলোতে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা : একদিকে ই-বর্জ্য থেকে মূল্যবান ধাতবসামগ্রী সংগ্রহের আকর্ষণ, অন্যদিকে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান তৈরির সুযোগ রয়েছে এ খাতে। মূলত এ দুটি
কারণে ই-বর্জ্য সংগ্রহ ও রিসাইক্লিং ব্যবসা গড়ে উঠছে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশে ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং এ যুক্ত হয়েছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
দেশে প্রথম ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নির্মিত হচ্ছে গাজীপুরে। সরকার এ খাতের উদ্যোক্তাদের অর্থ সহায়তা দেয়ার তথ্য চিন্তা করছে। তাই এ ই-বর্জ্যকে রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে মূল্যবান ধাতু সংগ্রহ করে বাণিজ্যের দ্বার উš§ুক্ত করতে হবে। ই-বর্জ্যের মধ্যে সিসা-পারদের মতো অস্বাস্থ্যকর বিষাক্ত পদার্থ যেমন থাকে, তেমনি তামা, কপার ও স্বর্ণের মতো মূল্যবান ধাতু সংগ্রহ করে বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে অনেক লাভবান হতে পারে। সাম্প্রতিক বিভিন্ন দেশে কী পরিমাণ ই-বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে
এবং এ বর্জ্য কোথায় যাচ্ছে তা পর্যালোচনা ও ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করার দরকার। ই-বর্জ্য থেকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কোমলমতি শিশুরা।
কম্পিউটার ও মোবাইলের মাদারবোর্ড ফুসফুস ক্যানসারের কারণ। বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিকের দ্বারা দূষিত বায়ুর কারণে নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় নানা ধরনের সমস্যা হয়। বাংলাদেশে এ খাতে ৮৩ শতাংশ শিশু-কিশোর জড়িত, যাদের অধিকাংশ ফুসফুস বিকল, উচ্চ রক্তচাপ, মানসিক বিষণ্নতা, নার্ভ সিস্টেমের দুর্বলতা, শ্রবণশক্তি হ্রাসসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত। তাই ই-বর্জ্য রিসাইক্লিংয়ে আরও স্বাস্থ্যকর ও উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ই-বর্জ্যের ঝুঁকি প্রতিহতের উপায়: ই-বর্জ্যের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে প্রচারণা, সচেতনতা ও জনমত তৈরিতে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যন্ত্র ব্যবহারের সঠিক পদ্ধতি আয়ত্তের মাধ্যমে একই যন্ত্র দীর্ঘদিন ব্যবহারের উপযোগী করার ওপর জোর দিতে হবে।
একই যন্ত্র একাধিক কাজ করবে এরকম বহুমুখী কার্যকর ইলেকট্রনিক যন্ত্রের ব্যবহার বাড়াতে হবে। উৎপাদনকারী সংস্থাগুলোকে রিসাইক্লিংয়ের ব্যবস্থা গড়ে তোলায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। অনানুষ্ঠানিক খাতে পরিবেশসম্মত ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব দিতে হবে। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় শিল্পোন্নত দেশগুলো থেকে উন্নত প্রযুক্তি আহরণে সচেষ্ট হতে হবে। এ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, পোশাকের ব্যবহার ও নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। নিজেদের বেঁচে থাকার জন্যই পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখতে হবে। আমাদের জীবন ও বেঁচে থাকার সঙ্গে পরিবেশ সম্পর্কিত। তাই পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখতে হলে অবশ্যই ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আর প্রতিশ্রুতিশীল হতে হবে আমাদের।