পরিবেশ কৃষি ও জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি ইটভাটা

মোহাম্মদ অংকন

আধুনিক সভ্যতা গড়ার অন্যতম উপাদান হলো ইট। যখনই ইট আবিষ্কার করা হলো, তখনই বিভিন্ন স্থাপত্যশৈলীর দেখা মিলতে লাগল। ধীরে ধীরে ইট আবাসিক কাজে ব্যবহার হতে লাগল। এখন অধিকাংশ বাড়িঘরই ইট দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে। ইটের চাহিদা প্রচুর। এই চাহিদার জোগান দিতে ইট প্রস্তুতকারকরা ইট তৈরিতে মানছে না কোনো নিয়ম-নীতি। দেশে বিভিন্ন আইন, তদারকি ও নিয়ন্¿ণকারী প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও ইটভাটার দৌরাত্ম্য কমছে না।

পরিবেশ মন্¿ণালয়ের জরিপ অনুযায়ী, দেশে সাড়ে ছয় হাজারের বেশি ইটভাটা রয়েছে। কিন্তু উদ্বেগের বিষয়, এর ৯০ শতাংশই জ্বালানি ব্যবহার, ইটভাটা স্থাপন ও পরিবেশ-সংক্রান্ত বিধান তারা মানছে না। তারা ক্রমেই বন উজাড় করছে, কৃষি জমির ক্ষতি করছে, দেশের ভূ-প্রকৃতি ধ্বংস করে মাটি পুড়িয়ে ইট তৈরি করছে। এতে ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় প্রকৃতি-পরিবেশ বিপন্ন হওয়ার পথে। ক্রমেই মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে এবং চাষাবাদের জমিজমা ও গাছপালা কমছে। এমন কি ইটভাটার আশপাশের গাছপালা মরে যাচ্ছে। চাষিরা ফুল-ফলের বাগান করতে পারছেন না। গাছের পাতা শুকিয়ে ঝরে পড়ছে। কৃষিজমিতে ফলন কম হচ্ছে।

বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্স স্টাডিজের হিসাবে, বছরে এক হাজার ৭০০ কোটিরও বেশি ইট তৈরি করা হয় এবং এর জন্য প্রয়োজন পড়ে পাঁচ হাজার ৮০০ কোটি টনেরও বেশি মাটি। বর্তমানে দেশের প্রতিটি জেলায় ইটভাটা রয়েছে। এসব ইটভাটায় কয়লার পাশাপাশি কাঠও পোড়ানো হচ্ছে। অথচ কাঠ পোড়ানো নিষিদ্ধ। ফসলি জমিতে লোকালয়ে এসব ইটভাটার চিমনির উচ্চতা কোনোটিরই ৬০ ফুটের বেশি নয়। অথচ চিমনি থাকতে হবে ১২০ ফুট লম্বা। ইটের ভাটার চিমনি থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ায় জেলাধীন এলাকার বাসিন্দারা অতিষ্ঠ। ইটভাটার কারণে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মানুষ শ্বাসকষ্ট ও চোখের রোগে বেশি আক্রান্ত হয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, ইটভাটা মাটি, পানি এবং জনস্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি করছে। ইটভাটার ধোঁয়ায় যে কার্বন মনোঅক্সাইড থাকে তা বাতাসকে যেমন দূষিত করে, তেমনি গাছপালা এবং ফসলের ক্ষতি করে। ইটভাটার বর্জ্যে যে সালফার থাকে তা নদী বা জলাশয়কে দূষিত করে। এর ফলে আশপাশের নদী থেকে মাছসহ সব ধরনের জলজপ্রাণী এবং উদ্ভিদ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ইটভাটার আগুনের প্রচণ্ড তাপে আশপাশের ফসলি জমি নিষ্ফলা হয়ে যাচ্ছে। এমনকি পার্বত্য এলাকার পাহাড়ও এখন ইটভাটার কারণে ঝুঁকির মুখে রয়েছে। আর ইটভাটার কারণে বাতাস দূষিত হওয়ায় মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্¿ণ) আইন, ২০১৩তে উল্লেখ করা আছে, ইটভাটায় ফসলি জমির উপরের মাটি (টপ সয়েল) ব্যবহার করলে প্রথমবারের জন্য দুই বছরের কারাদণ্ড ও দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। দ্বিতীয়বার একই অপরাধের জন্য ভাটা কর্তৃপক্ষকে ২ থেকে ১০ বছরের জেল এবং ২ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা যাবে। অনুমোদন না নিয়ে ইটভাটা স্থাপন করলে এক বছরের কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা যাবে। কিন্তু এখনও এই আইন বাস্তবায়ন করতে পারেনি বর্তমান সরকার। ফলে ইটভাটার আগ্রাসনও বন্ধ করা যাচ্ছে না। যেথা ইচ্ছা সেথা নিয়ম না মেনে ইটভাটা স্থাপন করে ইট তৈরি করা হচ্ছে। ফলে কমছে কৃষিজমির পরিমাণ।

ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের তথ্য মতে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মোট আবাদি জমির পরিমাণ ছিল দুই কোটি ১৭ লাখ একর। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, ১৯৮৪ সালে দেশে মোট আবাদি জমির পরিমাণ ছিল দুই কোটি ৩৮ হাজার একক। ১৯৯৭ সালে এসে কমে তা এক কোটি ৭৪ লাখ ৪৯ হাজার একরে এবং সর্বোপরি ২০১২ সালে বাংলাদেশের আবাদি জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় এক কোটি ৫৪ হাজার একর। প্রতি বছর জনসংখ্যা বাড়তির কারণে বাড়তি আবাসন, রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাঠামো নির্মাণে ভূমির ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয়েছে।

পরিসংখ্যানে এসেছে, দেশে প্রায় এক হাজার ২০০ ইটাভাটায় সরাসরি গাছ পোড়ানো হচ্ছে। ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহারে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ড্রাম চিমনি বিশিষ্ট ইটভাটা নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে তা টিকে আছে, সেই প্রশ্ন এখন আমাদের। ইট তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে ফসলি জমির উর্বর ও সারযুক্ত উপরিভাগের মাটি। এটা বন্ধে নিয়মিত মনিটরিং করা প্রয়োজন। ফসলি জমির মাটির উপরি অংশ কাটা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে জমির ফলন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকাংশে কমে যাবে। এতে হুমকির মুখে পড়বে দেশের কৃষি ও কৃষিজ খাদ্য নিরাপত্তা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইটভাটার কারণে পরিবেশদূষণ, ভূমির উবর্রতা হ্রাস ও বন উজাড় হচ্ছে। কৃষিজমি দিন দিন কমছে। ইটভাটায় মাটির জোগান দিতে ফসলের জমি অকেজো গর্তে পরিণত হচ্ছে। কেবল সমতল ভূমি নয়, কোথাও কোথাও পাহাড় পর্যন্ত কাটা হয় ইটভাটার মাটি জোগাড় করার জন্য। এমন কি ইট তৈরির জন্য কাঁচা মাটিও বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। দেশে এখন বছরে কম করে হলেও ১৭ দশমিক দুই বিলিয়ন পিস ইট তৈরি হচ্ছে। প্রতি মিলিয়ন ইট তৈরিতে পোড়াতে হয় ২৪০ মিলিয়ন টন কয়লা। কয়লার পাশাপাশি গ্রামঞ্চলে বনভূমি ধ্বংস করে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ ও বাঁশ। ইটভাটাগুলো থেকে বছরে কম করে হলেও ৯ দশমিক আট মিলিয়ন টন কার্বন-ডাইঅক্সাইড নির্গত হচ্ছে বায়ু মণ্ডলে, যা দেশের মোট কার্বন-ডাইঅক্সাইড নির্গমনের প্রায় ২৩ শতাংশ।

ইট আমাদের প্রয়োজনীয় উপকরণ। কিন্তু এর ক্ষতিকর দিক বিবেচনায় ও টেকসই উন্নয়নের জন্য পোড়া ইটের বিকল্প কংক্রিট ব্যবহারে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। কেননা ইটের বদলে ভবন নির্মাণে বালি, সিমেন্ট, নুড়ি পাথর দিয়ে বানানো কংক্রিট ব্যবহার স্থাপনার স্থায়িত্ব বৃদ্ধি করে। সেই সঙ্গে খরচ বাঁচায়। কোনো ব্রিকস খোয়া দিয়ে রাস্তা তৈরি এখন না করাই উত্তম। কারণ এটা দীর্ঘস্থায়ী নয়। কোথাও ইটের খোয়া দিয়ে রাস্তা করলে দেখা যায় ছয় মাসের মধ্যে সেগুলো গলে যাচ্ছে অথবা গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে। আর কংক্রিটের বাল্ক দিয়ে রাস্তা করলে তার স্থায়িত্ব দীর্ঘদিন হয়। তাই ইটের খোয়ার পরিবর্তে পাথরের চিপস দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করতে হবে।

দেশে যেহেতু পাথরের স্বল্পতা রয়েছে, তাই পাথর আমদানির ওপর শুল্ক সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে। মানুষকে পাথর ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হলে অবশ্যই শুল্ক কমাতে হবে। অন্যথায় মানুষ পাথর ব্যবহারে নিরুৎসাহিত হবে। উন্নত-উন্নয়নশীল দেশে ভবন নির্মাণে বালি, সিমেন্ট ও নুড়ি পাথর ব্যবহার করছে। এতে করে একদিকে যেমন কমছে কার্বন নির্গমন, অন্যদিকে রক্ষা পাচ্ছে ফসলি জমি। আমাদের দেশে কংক্রিট ব্যবহার ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। নদী থেকে ড্রেজিং করা বালির সঙ্গে সিমেন্ট এবং পাথর কুঁচি ব্যবহার করে তৈরি করা হচ্ছে এসব; যা পোড়ানোর প্রয়োজন নেই।

বর্তমানে জমির উপরিভাগের মাটি ব্যবহার করে যেভাবে ইট তৈরি করা হচ্ছে তাতে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই ইট ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করতে ইটভাটার ওপর বেশি বেশি কর আরোপ করতে হবে। একই সঙ্গে আগামী ২০২১ সালের মধ্যে সব ইটভাটা বন্ধ করা উচিত। ইটের পরিবর্তে হলগ্রাম বা কংক্রিটের ব্যবহার বাড়াতে হবে। যদি ইটের ব্যবহার বন্ধ করে কংক্রিটের

ব্যবহার বাড়ানো হয় তাহলে ১০ বছরের জন্য সব কংক্রিট তৈরি কারখানার ওপর ডিউটি ফ্রি করতে হবে। কৃষিজমি নষ্ট ও পরিবেশের ক্ষতি করে ইট তৈরি এবং উর্বর ফসলি জমির উপরের অংশ দিয়ে ইট বানানো বন্ধ করতে হবে। ইটভাটায় প্রযুক্তিগত পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করছি।

মাটির ইটের বিকল্প হিসেবে যেসব উপকরণ ও

প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে, তার ব্যবহার বাড়াতে হবে। সরকারের যেসব বিভাগ অবকাঠামো নির্মাণ ও তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত তাদেরও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। তাই অবিলম্বে সব সরকারি ও আধা সরকারি ভবনে ইট ব্যবহার বন্ধ করা হোক। ২০২১ সালের পর ঢাকাসহ সব বিভাগীয় শহরে ভবন নির্মাণে ইট ব্যবহার বন্ধ করা হোক। ২০২৫ সালের পর সব জেলা শহরে ভবণ নির্মাণে ইট ব্যবহার বন্ধ করা হোক। পাশাপাশি ইটের বিকল্প যে কোনো প্রকার কংক্রিট তৈরির ফ্যাক্টরিকে ন্যূনতম ১০ বছরের জন্য সব প্রকার ট্যাক্স ও ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখা হোক। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে পরিবেশ উপযোগী না উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক। ইটভাটার আগ্রাসন থেকে পরিবেশ, কৃষি ও জনস্বাস্থ্য রক্ষা পাক, এই প্রত্যাশা করি।

পরিবেশবাদী ও কলামিস্ট

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০