অমৃত চিছাম: বিশ্বে বর্তমানে যে কয়েকটি বিষয় বিশ্ববাসীর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু, তার একটি হলো পরিবেশ। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি সম্মেলনে পরিবেশ বিষয়টি বর্তমানে আলোচনার শীর্ষে অবস্থান করছে, যা বর্তমানে সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। সাধারণ অর্থে আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তা নিয়েই গঠিত হয় পরিবেশ; যা পৃথিবীর মধ্যে অবস্থিত সব প্রাণিক‚লের জন্য কতটা প্রয়োজনীয় তা সহজেই অনুমেয়। কারণ পরিবেশের বিপর্যয় ঘটিয়ে মানবজাতির অস্তিত্ব কল্পনা করা আর বোকার স্বর্গে বাস করা প্রায় একই কথা। বিশ্ব পরিবেশ বর্তমানে কঠিন সময় অতিবাহিত করছে। এর অন্যতম একটি প্রধান কারণ হলো যুদ্ধ। যুদ্ধের কথা চিন্তা করলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে শুধু ধ্বংসের চিত্র, হোক সেটা স্থাপনা কিংবা পরিবেশ। যুদ্ধ প্রায় প্রাচীনকাল থেকেই নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে চলে আসছে বিশ্বব্যাপী, আজকের দিনেও তার কোনো ব্যতিক্রম নই। কিন্তু সবকিছুর ঊর্ধ্বে যার ওপর এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে তা হলো আমাদের পরিবেশ। মাত্র কয়েক মিনিটের যুদ্ধ ধ্বংস করে দিতে পারে কয়েক প্রজšে§র সভ্যতা ও একইসঙ্গে এটি সর্বদাই পরিবেশ ধ্বংসের জন্য একটি কার্যকর নিয়ামক। মানব সৃষ্টির পর থেকে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ সংঘটিত হয়ে আসছে এবং এর ধারাবাহিকতা এখনও বিদ্যমান। যুদ্ধের ভয়াবহ তাণ্ডবে প্রাণ হারায় লাখ লাখ মানুষ, বিধ্বস্ত হয় অসংখ্য নগর ও জনপদ এবং ধ্বংস হয় আমাদের চারপাশে অবস্থিত পরিবেশ-প্রতিবেশ। আদিমকালে যুদ্ধে অস্ত্রের ব্যবহার ছিল অতি নগণ্য। কিন্তু দিন দিন যুদ্ধে অস্ত্র ব্যবহারের পরিমাণ এত বেড়েছে যে, বর্তমানে যুদ্ধ মানেই যেন অস্ত্র প্রদর্শনীর মহড়া। প্রাচীনকালে যুদ্ধাস্ত্র বলতে তলোয়ার, বর্শা, তীর-ধনুক, বল্লম, মিনজানিক (ঈধঃধঢ়ঁষঃ) প্রভৃতিকে বোঝানো হতো। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যুদ্ধাস্ত্রেও ডিজিটাল, লেজার গাইডেড ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। যার ধ্বংসলীলার প্রভাব ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী। আধুনিক সামরিক অভিযানে যেসব বোমা ও গোলা-বারুদ ব্যবহƒত হয় তা পরিবেশের ওপর ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং মানবজাতির অস্তিত্ব সংকটে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৯১৮) ১ লাখ ২৫ হাজার রাসায়নিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ৯০ লাখ সেনাসদস্য ও ৭০ লাখ বেসামরিক নাগরিক মারা যায়। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। পারমাণবিক বোমাটি বিস্ফোরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাপমাত্রা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস। মুহূর্তের মধ্যেই মানুষ, পশু-পাখি, জীব-জন্তু ও বন-বৃক্ষ পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়, ৫১ হাজার ৭৮৫ ঘরবাড়িতে আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যুদ্ধে ব্যবহার করা পারমাণবিক বোমার ক্ষতিকর বিকিরণের ফলে চোখ, ত্বক আর ফুসফুসের ক্যানসার নিয়ে বেঁচে আছে অসংখ্য নিরীহ মানুষ। পরে নাগাসাকি ও হিরোশিমায় জš§ নেয়া প্রায় অধিকাংশই শিশুই ছিল বিকলাঙ্গ। বোমা হামলার প্রায় ৭৮ বছর পেরিয়ে গেলেও জাপানের আকাশে-বাতাসে এখনও পারমাণবিক তেজষ্ক্রিয়তার প্রভাব বিদ্যমান। আজও দেশে দেশে যুদ্ধাস্ত্রের বিভীষিকা মানুষকে তাড়া করে বেড়ায়। জাতিসংঘ সর্বপ্রথম যুদ্ধের ভয়াবহতা ও এর পরিবেশগত বিষয়গুলো বিবেচনায় আনে। তারা দেখিয়েছে, যুদ্ধের ফলে কীভাবে দূষিত হয়েছে পানি সরবরাহ, সামরিক সুবিধার নামে কত শত একর ফসলি জমি পুড়িয়ে বা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে, গাছপালা কেটে বনভ‚মি ধ্বংস করা হয়েছে, ফলে সৃিষ্ট হয়েছে ব্যাপক হারে মাটি দূষণ। যার ভয়াবহতা সরাসরি প্রভাব ফেলেছে নিরীহ জীবজন্তুর ওপর। বিশ্বে অনুষ্ঠিত হওয়া যুদ্ধগুলোর মধ্যে অন্যতম পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হিসাবে ধরা হয় ভিয়েতনামের যুদ্ধকে। ওই যুদ্ধের প্রভাবে প্রায় ৪৯ লাখ হেক্টর বা ১৯ হাজার বর্গমাইল বনভ‚মি ধ্বংস করা হয়, যা কিনা স্কটল্যান্ডের সম্পূর্ণ আয়তনের দুই-তৃতীয়াংশের সমান বলে ধারণা করা হয়। এ যুদ্ধে মার্কিন সেনাবাহিনী ২ কোটি গ্যালন হারবিসাইডস স্প্রে করে বন-জঙ্গল পরিষ্কার করার জন্য। বলে রাখা ভালো এই ১৯ বছর ৫ মাসের যুদ্ধে ১ কোটি ৬০ লাখ টন যুদ্ধ সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়, যার ফলে সে সময় প্রায় ৩ কোটির বেশি খাদ সৃষ্টি করে। আর এই খাদগুলো তখন সেখানকার মাটির উপরের স্তর সরিয়ে ফেলে যার ফলে সেইসব স্থানের নিষ্কাশন ব্যবস্থা বিকল হয়ে যায় ও বদ্ধ পানিতে বিভিন্ন ধরনের রোগ বহনকারী ব্যাকটেরিয়া জš§াতে থাকে, যা বন্যপ্রাণীদের অতুলনীয় ক্ষতি সাধন করে। যুদ্ধে শত্রুকে লক্ষ্য করে যেসব ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয় তাতে যে শুধু শত্রæই নিহত হয় তেমনটি নয়, এছাড়া লাখ লাখ নিরীহ বন্যপ্রাণীর জীবন নাশ হয়ে থাকে। মানবিক বিবেচনার কথা বাদ দিয়ে দূরে থাকা যায় কিন্তু পরিবেশগত বিপর্যয় এর দায় কী এড়ানো যায়। যুদ্ধের ভয়াবহতায় বহু প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রজাতি ব্যাপক হারে হ্রাস পায়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রজাতিগুলো চিরদিনের জন্য পৃথিবী থেকেই বিলুপ্ত হয়ে যায়। এছাড়া বিশ্বে অনুষ্ঠিত যুদ্ধের ফলে সৃষ্টি হওয়া পরিবেশ বিপর্যয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো, আফগানিস্তানে, যুগোশ্লোভিয়ায় এবংউপসাগরীয় যুদ্ধে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের ব্যবহার পরিবেশের ওপর এক ভয়ানক ও সুদূরপ্রসারী ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিয়েছিল। তাছাড়া ১৯৯০-৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সামুদ্রিক দূষণের উপলক্ষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে,বিপুল পরিমাণ বোমাবর্ষণ করার ফলে মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের প্রায় ১৫ হাজার কিলোমিটার জলাভ‚মির জীববৈচিত্র্যকে নিশ্চিহ্ন হিসেবে ধারণা করা হয়েছে। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের দেয়া তথ্যমতে, ২০০ কোটি মানুষ কেবল নিরাপদ পানির অভাবে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ক্রমাগত আফ্রিকা এবং আরবভ‚মিতে যুদ্ধের ফলে সেসব অঞ্চলে সমস্ত উৎসের অতুলনীয় ক্ষতিসাধন হয়েছে, এর প্রভাবে বেড়েছে মাটি ও পানির দূষণ। বিশ্ব যুদ্ধের ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই সারা বিশ্বব্যাপী আবারও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে মাটি, বায়ু ও পানির দূষণ; যার ভয়াবহ চিহ্নের দেখা মিলবে ইউক্রেন, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, পর্তুগালসহ নিকটবর্তী সোভিয়েত রাশিয়ার এক বড় অংশে। আরও উদ্বেগের বিষয় এই যে, পরবর্তী সময় বিশ্ব পরিবেশ বিপর্যয়ের আরও নতুন নতুন উপসর্গ যোগ হতে থাকবে। পরিবেশ বিপর্যয়কে চ‚ড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছাতে নতুন করে যোগ হয়েছে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধ। পরিবেশে ওই যুদ্ধের ভয়াবহতা কীরূপ হতে পারে তা অতীতের সব যুদ্ধের দিকে তাকালে অতি সহজে অনুমান করা যায়। পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিস্ফোরণ (১৯৮৬) গভীর ক্ষত রেখে গেছে পুরো চেরনোবিলের সমগ্র অঞ্চলেই। ইউক্রেনে বিভিন্ন অংশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এক ডজনের বেশি পরমাণবিক চুল্লির ওপর যদি বোমা বর্ষণ করা হয় তাহলে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের লম্বা হাত কতদূর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে তা ভেবেই শিউরে উঠছেন বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদরা। রাশিয়া-ইউক্রেন চলমান যুদ্ধে ইউক্রেনে পেট্রোলিয়াম কারখানায় বোমা হামলায় বায়ুদূষণের মাত্রা নিঃসন্দেহে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেবে এবং তা কী পরিমাণ ধ্বংসাত্মক হতে পারে, তা কল্পনাতীত। শিল্প-সমৃদ্ধ ইউক্রেনের প্রাকৃতিক পরিবেশ যুদ্ধের আগে থেকেই বিপর্যস্ত কারখানা-নিষ্কৃত দূষণ সংঘটিত হওয়ার ফলে। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ডনবাস শহর সবচেয়ে দূষণযুক্ত অঞ্চল হিসেবে আগে থেকেই সুনাম অর্জন করেছে তার কয়লাখনি, ধাতু-শিল্পের কারখানা ও কয়েকশ রাসায়নিক কারখানার জন্য। শিল্পোন্নত শহরে বোমা-গ্রানাইট-মিসাইল বর্ষণ মানে কী পরিমাণ দূষণ ও ভয়াবহ হতে পারে; তা সহজে অনুমেয়। পেট্রোলিয়ামপূর্ণ কারখানা বা অন্যান্য দাহ্যবস্তুতে পূর্ণ কারখানায় একটি বোমা ফেলা হয় তাহলে সেখানে পরিবেশের তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘস্থায়ী কী পরিমাণ ক্ষতি হতে পারে একবার চিন্তা করলেই গা শিউরে ওঠে। আর এই ঘটনা যদি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোয় ঘটে তাহলে তা বিস্ফোরণে উড়ে গিয়ে বাঁধের নি¤œ অববাহিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভেসে যাবে। ফলে দেখা দিবে প্রবল বন্যা। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর মত অনুযায়ী যুদ্ধেরও একটি নীতি রয়েছে। আর তা হলো এই যে, রণক্ষেত্রে প্রতিক্ষের অশীতিপর বৃদ্ধ, নারী, শিশু ও ধর্মীয় উপসনালয়ে অবস্থানরত পুরোহিতদের হত্যা করা যাবে না। অকারণে বৃক্ষ নিধন করা যাবে না। ক্ষেতের ফসল নষ্ট করা যাবে না। যে কোনো ধরনের স্থাপনা ধ্বংস করা যাবে না। সর্বোপরি তিনি পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রধান নিয়ামকগুলোর ওপরই জোর দিয়েছেন। পৃথিবীর সব শান্তিকামী মানুষ যুদ্ধ পরিহার করে শান্তির পথে পথ চলুক এতাই সবার প্রত্যাশা। অন্যথায় পৃথিবী নামক এ গ্রহে মনুষ্য জাতির অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।
শিক্ষার্থী
এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
ত্রিশাল, ময়মনসিংহ