পরোক্ষ ধূমপান: ধূমপায়ীর চেয়ে বেশি ক্ষতি আশপাশের মানুষের

জীবন রায়হান: অনেকে মনে করেন, আমি সিগারেট খাই না। আমার তো কোনো ক্ষতি হওয়ার কথা না। তবে এক্ষেত্রে দেখা যায়, সিগারেট খায় এমন ১০০ জনের মধ্যে শতকরা পাঁচজনের এ সমস্যা হতে পারে। বিশেষ করে তার পরিবারের লোকজন যারা আছে তাদের ক্ষেত্রে। বাসায় যদি কেউ সিগারেট খায় তাহলে পরিবারের অন্য সদস্যদেরও (সিওপিডি) ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে।

রাজধানীর মিরপুরে রাস্তার একপাশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তারেক আজিজ দিব্যি সিগারেট টানছেন। পাশ দিয়ে এক মুরব্বি যাচ্ছেন, তার গায়ে সিগারেটের ধোঁয়া এসে লাগলে খুবই বিরক্তিবোধ করে তিনি চলে গেলেন। পুরান ঢাকায় কবি নজরুল কলেজ গেটে টংয়ের দোকানের সামনে এক তরুণের সিগারেট খাওয়া দেখে, কয়েকজন মেয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল এই যে ভাইয়া আপনি সিগারেট খাচ্ছেন অন্যজনের গায়ে ধোঁয়া লেগে যায়। এতে আপনিও ক্ষতি হচ্ছেন, সঙ্গে আশপাশে মানুষদেরও ক্ষতি হচ্ছে।

ধূমপানরত ব্যক্তির ধোঁয়া দ্বিতীয় ব্যক্তি গ্রহণ করলে সেটাকে পরোক্ষ ধূমপান বলা হয়। এটা দু’ভাবে আসতে পারে, ধূমপানরত ব্যক্তির জ্বলন্ত বিড়ি বা সিগারেটের পাশ থেকে নির্গত ধোঁয়া কিংবা ধূমপায়ী ধোঁয়া গ্রহণের পর নিঃশ্বাসের সঙ্গে পরিত্যক্ত ধোঁয়া। বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত অংশের পাশ থেকে নির্গত ধোঁয়া দিয়ে কোনো একটি কক্ষের মোট ধোঁয়ার ৮৫ শতাংশ ভরে থাকে।

অন্যের ধোঁয়া পান করলে চোখ জ্বালাপোড়া, মাথাব্যথা, গলাব্যথা, বমি বমি ভাব প্রভৃতি হয়। হাঁপানি রোগীর হাঁপানির প্রকোপ বাড়াতে পরোক্ষ ধূমপান বিশেষভাবে দায়ী। বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের ফলে হƒদরোগ ও ফুসফুসের ক্যানসারের প্রকোপ ২৫ শতাংশ বেড়ে যায়। আর কর্মস্থল ও পথে-ঘাটে পরোক্ষ ধূমপানের ফলে হƒদরোগের হার বেড়ে যায় ৫০-৬০ শতাংশ। ধূমপান যারা করেন এবং যারা ধূমপায়ীদের আশপাশে থাকেন ও ধোঁয়ার সংস্পর্শে আসেন, তাদেরও ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি।

ধূমপানবিরোধী ক্যাম্পেইন গ্রুপ অ্যাশের প্রধান নির্বাহী ডেবোরাহ আরনট বলেন, ১৯৫০ সালে প্রথম আবিষ্কৃত হয় যে ধূমপানের সঙ্গে ফুসফুসের ক্যানসারের সম্পর্ক রয়েছে। এরপর গত কয়েক দশকের নানা গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রায় সব ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যার ক্ষেত্রে ধূমপানের কারণে আরও খারাপ অবস্থা তৈরি হয়।

গবেষকদের একজন ড. ওলগা পারস্কি বলেন, গবেষণার প্রধান আবিষ্কার হলো, সাবেক ধূমপায়ীরাও অপেক্ষাকৃত বেশি শারীরিক যন্ত্রণা নিয়ে জীবনযাপন করেন। কিন্তু এটি চিকিৎসা অর্থবহ কি না, সেটি এখনও নিশ্চিত নয়।

ধূমপান হচ্ছে তামাক জাতীয় দ্রব্যাদি বিশেষ উপায়ে প্রক্রিয়াজাত করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে শ্বাসের সঙ্গে তার ধোঁয়া শরীরে গ্রহণের প্রক্রিয়া। সাধারণ কোনো দ্রব্যের পোড়ানো ধোঁয়া শ্বাসের সঙ্গে দেহে প্রবেশ করলে তাকে ধূমপান বলা হলেও মূলত তামাকজাতীয় দ্রব্যাদির পোড়া ধোঁয়া গ্রহণকেই ধূমপান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিভিন্ন বৈজ্ঞানিকসহ মোটামুটি সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত যে, ধূমপান যক্ষ্মা, ফুসফুসের ক্যানসারসহ নানা রোগের অন্যতম প্রধান কারণ এবং ধারক ও বাহক।

কার্বন মনোক্সাইড আমাদের পেশি, টিস্যু ও মস্তিষ্কের অক্সিজেনকে নিঃশেষ করে দেয়। ফলে হার্টকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয় এসব টিস্যুকে অক্সিজেনেটেড রাখতে। ফলে একসময় দেহের বায়ু প্রবেশপথ ফুলে ওঠে ও শেষে দেখা যায় ফুসফুসে কম বাতাস প্রবেশ করে।

ধূমপান এলেই একটি সামাজিক ব্যাধি। এটি সামাজিক ও শারীরিক ব্যাধি। ধূমপান অনেক সামাজিক বিপর্যয় নিয়ে আসে। আমরা একটু পথে-ঘাটে তাকালে দেখব, অসংখ্য মানুষ জ্বলন্ত সিগারেট হাতে নিয়ে ঘুরছে। এটি একটি ভয়াবহ দিক। তবে যারা এ রকম করছে, তাদের কাছে এটি বড় কোনো বিষয় মনে হয় না। তারা এটিকে স্বাভাবিক বলে মনে করে। মনে করে, এটি কোনো ব্যাপারই নয়। এটি আসলেই খুব জঘন্য একটি বিষয়। সমাজের মানুষের ওপর এর প্রভাব খুবই মারাত্মক।

যেসব অধূমপায়ী পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন, তাদের ফুসফুসের ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা ২০-৩০ শতাংশ বেশি থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, পরোক্ষ ধূমপানের ফলে ৪ হাজারের বেশি কেমিকেলের ঝুঁকিতে থাকেন অধূমপায়ীরা। সেগুলোর মাঝে ৬৯টি কেমিকেল ফুসফুসের মতো ক্যানসার ঘটানোর জন্য দায়ী।

পরোক্ষ ধূমপানের কারণে একজন অধূমপায়ী আরও একটি বড় অসুখের ঝুঁকিতে পড়ে, তা হলো অ্যাজমা। এতে করে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা বেড়ে যায়। গর্ভবতীরা পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বড় ঝুঁকিতে থাকেন। এতে গর্ভবতীর শরীর যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি মা ও শিশুর অকালমৃত্যু হতে পারে। গর্ভবতীরা পরোক্ষ ধূমপানের কারণে অপরিণত শিশুর জন্ম দেয়। এক্ষেত্রে ওই শিশুর ওজন হয় তুলনামূলকভাবে কম, যাতে অনেক সময় ওই শিশুর বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে।

নবজাতক শিশুদের ক্ষেত্রে আকস্মিকভাবে মৃত্যুর একটি বিশেষ কারণ পরোক্ষ ধূমপান। একজন মানুষ হয়তো বিষয়টি পছন্দ করে না, তার তো খারাপ লাগতে পারে। তার কাশি হতে পারে, শ্বাসকষ্ট হতে পারে। শেষ পর্যন্ত তো বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হতেই পারে। আবার অনেক সময় কেউ ধূমপান করল, অন্য কেউ প্রতিবাদ করল, এতে দুই পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে।

সুস্থ জীবনযাপন করতে হলে, ধূমপান পরিহার করতে হবে। বুঝতে হবে, ধূমপান কেবল নিজের ক্ষতি নয়, নিজের সন্তানদের ক্ষতি এবং সমাজেরও। আর নিজের জীবন বিপন্ন হয়ে গেলে তো পরিবারের অন্যদেরসহ সে সঙ্গে সমাজের মানুষের জীবনও বিপন্ন হয়ে যাবে। আর তাই ধূমপান এখন থেকেই বন্ধ করতে হবে। তাহলেই আমরা একটি সুস্থ সমাজ গড়ে তুলতে পারব।

পিআইডি নিবন্ধন

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০