পরোক্ষ ধূমপান: শিকার নারী ও শিশু

তারেক হাবিব:‘বাবা আমার চোখ জ্বলছে, শ্বাস ফেলতেও কষ্ট হচ্ছে। ধোঁয়ায় মাথা ঘুরছে। ঘরে সিগারেট না খেলে হয় না, সিগারেট ছেড়ে দাও না কেন?’ পরিবারের গৃহকর্তার সঙ্গে তার শিশুকন্যা ও মায়ের কথোপকথন, যিনি শিশুর বাবা হয়েও সন্তানের জন্য সচেতন নন। বরং পরিবারের সদস্যদের অভিযোগের বিনিময়ে তাদের জুটেছে গৃহকর্তার ধমক। ঘটনাটি ঢাকা শহরের একটি বাড়ির।

ওপরে বর্ণিত কাহিনি কোনো একক ঘটনা নয়; বরং উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত বা নিন্মবিত্ত সব শ্রেণির অসংখ্য পরিবারের নারী-শিশুকেই এমন অভিযোগের কথা বলতে শোনা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা প্রতিকার তো পানই না, উল্টো কটাক্ষ সহ্য করতে হয়। তাই বাধ্য হয়েই পরোক্ষভাবে তাদেরও পান করতে হয় জীবনঘাতী এসব বিষ। ঘরের বাইরেও বাস, ট্রেন, লঞ্চ, পার্ক, জনবহুল স্থান কিংবা কর্মক্ষেত্রেও নারী ও শিশুরা অথবা অধূমপায়ীরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও ধূমপানের বিষ গ্রহণ করে চলেছেন। আর আক্রান্ত হচ্ছেন নানা জটিল রোগ-ব্যাধিতে।

মাদকদ্রব্য নিরোধ সংস্থার (মানস) ২০১৫ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রায় ৩৫ শতাংশ নারী ও শিশু পরোক্ষ ধূমপানের শিকার। ধূমপানের কারণে হƒদরোগ ও ফুসফুসের ক্যানসারের ঝুঁকি ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বেড়ে যায়। ধূমপান ও তামাক সেবনের কারণে আক্রান্ত রোগ-ব্যাধির চিকিৎসা বাবদ প্রতিবছর ব্যয় হয় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। তামাক সেবনের কারণে অর্থনীতিতে বছরে ক্ষতি দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা।

গাইনিকোলজির চিকিৎসকদের মতে, সিগারেট থেকে নির্গত ধোঁয়া এবং এতে মিশে থাকা বিষাক্ত উপাদান গর্ভস্থ শিশুর রক্তসঞ্চালন কমিয়ে দেয়। এর ফলে বিকলাঙ্গ সন্তান জন্ম নিতে পারে। ধূমপায়ী নারীদের ঠোঁটকাটা এবং তালুকাটা সন্তান জন্ম দানের হার অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। মায়েদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাব পড়ে শিশুর জন্ম-পরবর্তী সময়েও। এর বিরূপ প্রভাবে শিশু স্বল্প বুদ্ধিসম্পন্ন, অমনোযোগী ও অতিচঞ্চল হতে পারে। এ ক্ষেত্রে শিশুদের থাকতে পারে বিভিন্ন আচরণগত সমস্যা, যা লেখাপড়া করার ক্ষেত্রে পরবর্তীকালে সৃষ্টি করতে পারে বিভিন্ন সমস্যা। এমনকি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধূমপানের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে হঠাৎ মৃত্যুও হতে পারে এসব শিশুর।

রাজধানীর বিভিন্ন বাসস্ট্যন্ড, বাজার ও রেলওয়ে স্টেশনসহ জনাকীর্ণ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ধূমপায়ীরা নির্দ্বিধায় উম্মুক্ত জায়গায় ধূমপান করে যাচ্ছে, যদিও বাংলাদেশে ধূমপানবিরোধী আইন এবং জেল-জরিমানার বিধানও রয়েছে। একই সঙ্গে প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেট, বিড়িসহ তামাকজাতীয় দ্রব্য। রাজধানীর কমলাপুর, টঙ্গী, বিমানবন্দর ও তেজগাঁও রেলস্টেশনে তামাকপণ্য বিক্রি করছে হকাররা। আবার অনেক নারী ও শিশুও এসব পণ্য বিক্রি ও প্রস্তুতের কাজ করছে। শুধু ঢাকায় কমলাপুর রেলস্টেশনেই তামাকজাতীয় পণ্য বিক্রি করছে প্রায় শতাধিকের ওপর হকার।

এমনই এক নারী হকার ফরিদা বেগম। তিনি জানান, রেলস্টেশনে ১১ বছর ধরে পান, সিগারেটসহ বিভিন্ন তামাকজাতীয় পণ্য বিক্রি করছেন। নারী যাত্রীরাও অনেক সময় তার কাছ থেকে এগুলো কেনে। তার সিগারেট রাখার বাক্সটি একটি নামকরা সিগারেট কোম্পানি বানিয়ে দিয়েছে। কোম্পানিভেদে বেশি বিক্রি দেখাতে পারলে নানা উপহারসহ নগদ টাকা বোনাসও পান তিনি। হকার শামীম ও সেলিম মিয়া জানান, টঙ্গী থেকে কমলাপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত প্রায় ২০০ হকার রয়েছে। ট্রেনের ভেতর ও প্ল্যাটফর্মে তারা সিগারেটসহ তামাকপণ্য বিক্রি করেন। নিরাপত্তাবাহিনীকে ম্যানেজ করে তারা এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। শিশু হকার মুন্না জানায়, সিগারেটের সঙ্গে পুরিয়াও বিক্রি হয় তার কাছ থেকে। পুরিয়া কী জানতে চাইলে সে বলে, বিশেষ প্যাকেটে রাখা সিগারেটের তামাক ফেলে তাতে গাঁজা ঢুকিয়ে পুরিয়া বলে বিক্রি করা হয়।

চট্টগ্রাম থেকে আসা আন্তঃনগর সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনের এক নারী যাত্রী জানান, ‘আমাদের সামনেই দুটো ছেলে সিগারেট টানছিল। প্রতিবাদ করেও অনেক ক্ষেত্রেই লাভ হয় না।’ অনেক বখাটে ছেলে মহিলাদের দেখে বেশি ধূমপান করতে থাকে। আবার ধুমপায়ী ও মাদকাসক্ত স্বামীদের কারণেও অনেক নারী ও শিশু ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়ে।

অনেক পরিবারে বাবার সঙ্গে সন্তান ও মায়ের প্রায়ই ঝগড়া হয়। বাবাকে ধূমপানে নিষেধ করতে গেলে বকা শুনতে হয়। মিরপুরের গার্মেন্ট কর্মী সোনিয়া জানান, তার স্বামী প্রচুর ধূমপান করতেন। নিষেধ করলেই গায়ে হাত তুলতেন। প্রথম সন্তানটি নষ্ট হয়। এরপর তিনি স্তনে ক্যানসারে আক্রান্ত হন। তারপরও তার স্বামীর নেশা ছাড়েনি। কিছুদিন আগে তার স্বামী স্ট্রোক করে মারা গেছেন। এসবই ধূমপানের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশেগুলোয় ধূমপায়ীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ২০১০ সালে বিশ্বে ধূমপায়ীর সংখ্যা ছিল ১২০ কোটির ওপরে, যা এ বছরের শেষের দিকে ১৫০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। আর তামাক ব্যবহারজনিত বিভিন্ন রোগ-ব্যাধির কারণে মৃত্যু ঘটবে প্রায় পাঁচ কোটি লোকের। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট সার্ভের মতে, বাংলাদেশে ১৫-ঊর্ধ্ব বয়সী জনগোষ্ঠীর ২৩ শতাংশ ধূমপান করে। দেশে বর্তমানে ধূমপায়ীর সংখ্যা দুই কোটি ১৯ লাখ, যার মধ্যে দুই কোটি ১২ লাখ পুরুষ আর সাত লাখ নারী। দেশে বর্তমানে ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করছে এক বিরাট জনগোষ্ঠী। উঠতি বয়সী কিশোর-কিশোরী ও যুব তরুণদের মধ্যে ইদানীং ভেপ নামক নেশার মারাত্মক আসক্তি লক্ষ করা যাচ্ছে। এতে নিকোটিনের মাত্রা কম থাকলেও ভেপ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

ধূমপানবিরোধী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ডা. অরূপ রতন রায় চৌধুরী বলেন, যারা ধূমপায়ীদের সঙ্গে বসবাস করেন, তাদের হƒদরোগ ও ফুসফুসে ক্যানসার হওয়ার প্রবণতা অন্যদের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি। একজন ধূমপায়ী নিজে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি তার পরিবারের অন্যদেরও ক্ষতি করছে। তিনি আরও বলেন, পরোক্ষ ধূমপানের ফলে গর্ভের প্রথম ও শেষ তিন মাসের গর্ভস্থ শিশুর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়। এজন্য পরোক্ত ধূমপান ভূমিকা রাখে অকালে গর্ভপাত, অপরিণত শিশুর জন্ম, স্বল্প ওজনের শিশু, গর্ভকালীন রক্তক্ষরণ, প্রসবের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, মৃত শিশুর জন্ম দেয়া প্রভৃতি সব ভয়ংকর সমস্যা সৃষ্টির ক্ষেত্রে। আবার গর্ভাবস্থায় পরোক্ষ ধূমপানের প্রতিক্রিয়া সন্তানের কিশোর বয়সেও দেখা যায়। ধূমপায়ী মায়ের স্কুলপড়–য়া সন্তানদের সঙ্গে অধূমপায়ী মায়ের একই বয়সের সন্তানদের আচরণগত পার্থক্য দেখা যায়। আচারণ পার্থক্য ছাড়াও তামাকের ধোঁয়ার অন্তত ৬০ রকমের উপাদান রয়েছে, যেগুলো ক্যানসার সৃষ্টির জন্য সরাসরি দায়ী। সুতরাং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ধূমপান সুস্থ জীবনের জন্য সরাসরি প্রতিবন্ধকতা।

হƒদরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে বিশেষ করে নারী ও শিশুরা। এসব নারী-শিশুরা প্রায়ই হƒদ্যন্ত্রের চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে আসছে। ধূমপানের পরোক্ষ ধোঁয়া গ্রহণের ফলে চোখ জ্বলা ভাব, মাথাব্যথা, বমি-বমি ভাবসহ বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিতে পারে। একটানা ৩০ মিনিট কোনো অধূমপায়ী পরোক্ষভাবে ধূমপান করলে তা হƒৎপিণ্ডের রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

আমাদের দেশে অসংখ্য নারী ও শিশু পরোক্ষ ধূমপানের কারণে নানা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। অথচ এ পরিণতির জন্য তারা মোটেও দায়ী নয়। তাই নারী ও শিশুদের রক্ষার জন্য ধূমপানবিরোধী আইনের কঠোর বাস্তবায়ন এবং ধূমপানের ক্ষতিকর দিকগুলো ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রচার করে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা এখন সময়ের দাবি। এ দায়িত্ব আমাদের সবার এবং আমরা তা এড়াতে পারি না কোনোভাবেই।

পিআইডি নিবন্ধন

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০