নির্ধারিত সময়ে কোনো উন্নয়ন প্রকল্পই শেষ করতে পারে না রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন সংস্থা। এক বা একাধিকবার মেয়াদ বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রকল্প ব্যয় বাড়ে এতে। সম্প্রতি এ নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ভবিষ্যতে কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হবে না বলে তিনি নির্দেশনাও দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন বিলম্বের কারণ অনুসন্ধান করে শেয়ার বিজ। এ নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের আজ ছাপা হচ্ছে চতুর্থ পর্ব
ইসমাইল আলী: ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা চার লেনের মহাসড়কটি উদ্বোধন করা হয়েছে গত বছর ১২ মার্চ। তবে প্রকল্পটির বেশকিছু কাজ তখনও বাকি ছিল, আগামী জুনের মধ্যে যা শেষ করার কথা রয়েছে। এজন্য প্রকল্পটিতে প্রায় এক হাজার ৯৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দরকার। কিন্তু চলতি অর্থবছরের বাজেটে প্রকল্পটির বিপরীতে বরাদ্দ রয়েছে মাত্র ৪০০ কোটি টাকা।
এ অবস্থায় পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাবে আগামী জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ার শঙ্কা করা হচ্ছে। এজন্য প্রকল্পটিতে বরাদ্দ বৃদ্ধির জন্য কয়েক দফা প্রস্তাব দিলেও কাজ হয়নি। সংশোধিত এডিপিতে (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) পুরো অর্থ বরাদ্দ না দিলে নির্মাণকাজ শেষ না করে আরও এক বছর ঝুলিয়ে রাখতে হবে প্রকল্পটি।
রেলের ১০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন কেনা প্রকল্পের অবস্থাও একই। গত অক্টোবরে ইঞ্জিনগুলো দেশে এসে পৌঁছেছে। ঠিকাদারের বিল ও সিডি-ভ্যাটসহ অন্যান্য পাওনা পরিশোধে চলতি অর্থবছর ৪০২ কোটি ৮২ লাখ টাকা বরাদ্দ দরকার প্রকল্পটিতে। তবে এর বিপরীতে এডিপিতে বরাদ্দ দেয়া আছে ১৬৮ কোটি টাকা। এতে পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাবে জুনে প্রকল্পটি শেষ করা যাবে না। এজন্য সংশোধিত বাজেটে পুরো অর্থ বরাদ্দের চিঠি দেয়া হয়েছে। তবে তা পাওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে।
সরকারের ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পেও রয়েছে অপর্যাপ্ত বরাদ্দের চিত্র। প্রকল্পটিতে চলতি অর্থবছর তিন হাজার ২৫৭ কোটি ৩৬ লাখ টাকা বরাদ্দ আছে। তবে প্রকল্পের কাজ সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে নিতে চলতি অর্থবছর কমপক্ষে পাঁচ হাজার ৪৮৬ কোটি চার লাখ টাকা লাগবে। ফলে ২০২০-২১ অর্থবছরে অতিরিক্ত এক হাজার ৮০১ কোটি ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ চেয়ে গত মাসে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়। অতিরিক্ত বরাদ্দ না পাওয়া গেলে ঠিকাদারের বিল পরিশোধে বিলম্বের কারণে রেলওয়েকে জরিমানা গুনতে হবে বলে চিঠিতে বলা হয়। তবে এখনও বিষয়টি সমাধান হয়নি।
এভাবেই বরাদ্দের অভাবে প্রতি বছর বিভিন্ন প্রকল্প শেষ করা যায় না। আবার ইচ্ছাকৃতভাবে নামমাত্র বরাদ্দ দিয়ে বছরের পর বছর বাঁচিয়ে রাখা হয় বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প।
গত কয়েক বছরের এডিপি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কোনো প্রকল্পে ১০ লাখ টাকা, কোনোটায় পাঁচ লাখ আবার কোনোটিতে মাত্র এক লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয় প্রকল্প। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬৪টি প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল এক লাখ টাকা করে। ২০১৯-২০ বছরে এক লাখ টাকা করে বরাদ্দ ছিল ৫৫টি প্রকল্পে। আর চলতি অর্থবছরের বাজেটে ৬৬টি প্রকল্পে এক লাখ টাকা করে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ফলে এসব প্রকল্প কবে শেষ হবে তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।
নামমাত্র বরাদ্দের কারণে উন্নয়ন প্রকল্প বছরের পর বছর ঝুলে থাকার বিষয়টি বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায়ও উঠে এসেছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের এডিপি বিশ্লেষণ করে ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, ওই অর্থবছর এডিপিতে এক হাজার ৩৪টি প্রকল্প ছিল। তবে যে ধারাবাহিকতায় অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তাতে ৩২টি প্রকল্প শেষ হতে ১০০ বছরের বেশি সময় লাগবে। ওই অর্থবছর এডিপিতে এমন ১০৬টি প্রকল্প ছিল যেগুলো শেষ হতে ১১ থেকে ১০০ বছর সময় লাগবে। আর ১৫৪টি প্রকল্প ছয় থেকে ১০ বছরে শেষ হবে এবং ৭২৫টি প্রকল্প শেষ হবে পাঁচ বছরের মধ্যে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নয়ন বাজেটে বরাদ্দ পাওয়ার ক্ষেত্রে এখন বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামো (এমটিবিএফ)। এর কারণে চাইলেও এডিপিতে বাড়তি বরাদ্দ পাওয়া সম্ভব নয়। আগামী দুই বছরের জন্য এমটিবিএফে সিলিং নির্ধারণ করে দেয়া আছে। এক্ষেত্রে ২০২১-২২ অর্থবছরের সিলিং হলো চলতি বছরের চেয়ে আট শতাংশ বেশি। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য সিলিং ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ১১ শতাংশ বেশি।
এ প্রসঙ্গে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, চলতি অর্থবছরে কোনো মন্ত্রণালয় এডিপিতে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ পেলে আগামী অর্থবছর তাকে সর্বোচ্চ ১০৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হবে। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে বরাদ্দ দেয়া হবে সর্বোচ্চ ১১৯ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। যদি খুবই জরুরি প্রয়োজনে কোনো প্রকল্পটি অতিরিক্ত বরাদ্দ দরকার হয়, তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ে ডিও লেটার (আধা-সরকারি পত্র) দিতে হয়। তবে তাতেও কাজ হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় থাকে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘একটা কথা নিশ্চিত যে অর্থনীতিটা বাড়তে থাকবে। মাত্র এক বছর আগেই আমরা আট শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিলাম। কভিড না এলে হয়তো সাড়ে আট শতাংশ অতিক্রম করত। এটা খুবই ভালো প্রবৃদ্ধি। ওই প্রবৃদ্ধি চলমান থাকলে আমাদের নতুন নতুন প্রকল্প নিতে কোনো ভয় পেতে হতো না। সেক্ষেত্রে কেবল নিজস্ব সম্পদ নয়, আমরা ভবিষ্যতের জন্য দেশের বাইরে থেকে ধার-কর্জ করতে পারতাম নিশ্চিন্তে। তবে প্রয়োজন অনুপাতে বরাদ্দ দিতে না পারায় অনেক সময় প্রকল্প বাস্তবায়নে যে বিলম্ব হচ্ছে, এটা তথ্য। কিন্তু এই বিলম্বের কারণ একমাত্র আর্থিক নয়। আমার মতে, বিলম্ব হওয়ার অন্যতম কারণ সমন্বয়হীনতা। কারণ যে কোনো প্রকল্পের ক্ষেত্রে একাধিক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা থাকে। এখানে এক ধরনের ‘টার্ফ’ ব্যাটেল সৃষ্টি হয়। যেমন আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, সময়মতো চিঠির জবাব না দেয়া প্রভৃতি।’