একই ক্ষেতে বছরজুড়ে ফুল ও সবজি চাষ করে সাড়া ফেলেছেন যশোরের গদখালীর কৃষকরা। পলিশেডে ফগার ইরিগেশন ব্যবহার করে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াই নিরাপদ বিষমুক্ত ও রপ্তানিমুখী সবজি ও ফুল উৎপাদন করছেন তারা। এখানকার চাষিদের সফলতা দেখে জেলার অন্য এলাকার চাষিরাও ফুল ও সবজি চাষে পলিশেড ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
ফুল চাষের রাজধানীখ্যাত গদখালীতে উৎপন্ন ফুল দেশে উৎপাদিত মোট ফুলের ৬০ ভাগ। ফুল চাষ করতে গিয়ে প্রতিবছর এখানকার কৃষকরা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়েন। আর্থিক ক্ষতি হয় তাদের। বিশেষ করে প্রচণ্ড শীত, গরম ও ভারী বৃষ্টির কারণে লাখো টাকার ফুল নষ্ট হয়। ফলে লোকসান গুনতে হয় এখানকার কৃষকদের। তাদের এ ক্ষতির দিকটি বিবেচনা করে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি সেচ) উদ্যোগে গদখালীতে পলিহাউজের মাধ্যমে ফুল চাষের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় গদখালীতে সাতটি পলিহাউজে বর্তমানে একই সঙ্গে চাষ হচ্ছে ফুল ও সবজি। এতে চাষিরা অল্প খরচে বেশি লাভবান হচ্ছেন বলে জানা গেছে।
সবজি, ফুল ও মাছের জেলা হিসেবে সারা দেশে পরিচিত যশোর। গদখালী ফুল চাষের জন্য বিখ্যাত হলেও এখানে সবজি চাষের তেমন প্রচলন ছিল না। কিন্তু উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষক এখন একই ক্ষেতে বছরজুড়ে ফুল ও সবজি চাষ করে বাড়তি আয় করছেন।
গদখালীর পানিসারা গ্রামের ফুলচাষি ইসমাইল হোসেন বলেন, আধুনিক পলিহাউজে পানিসাশ্রয়ী ড্রিপ ইরিগেশন, স্প্রিংকলার ইরেশন, সৌরচালিত পাম্প, ক্লাইমেট স্মার্টসহ নানা প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে কোনো ঝামেলা ছাড়াই প্রায় বছরজুড়ে ফুল ও সবজি চাষ করে লাভবান হচ্ছেন তারা। তিনি আরও বলেন, গদখালী এলাকার ফুলচাষিরা প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অনেক সমস্যায় পড়েন। বর্ষাকালে বেশি বৃষ্টিপাত হলে ক্ষেতের ফুল নষ্ট হয়। আবার গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বেড়ে গেলে ক্ষেতেই ফুলের সর্বনাশ হয়ে যায়। একই অবস্থা শীতকালে। কিন্তু এ পদ্ধতির মাধ্যমে চাষ করে তারা মোটেও সমস্যায় পড়েন না। পলিহাউজের কারণে বৃষ্টির পানিতে ক্ষেতের ফসলের কোনো সমস্যা হয় না। অপরদিকে তাপমাত্রা বেড়ে গেলে ফগার ইরিগেশনের মাধ্যমে তাপ নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
একই কথা বলেন, ফুলচাষি শের আলী সর্দার। তিনি বলেন, পলিহাউজ সিস্টেমের মাধ্যমে আমাদের অঞ্চলে ফুল চাষে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। আমি এক বিঘা জমিতে পলিহাউজের মাধ্যমে ফুল ও সবজি চাষ করেছি। একই জমিতে জারবেরা, গ্লাডিউলাস, রজনীগন্ধা, গোলাপসহ ১২ ধরনের সবজি চাষ করেছি। এসব ফসল চাষে কোনো সমস্যা পোহাতে হয় না। সৌরচালিত পাম্প দিয়ে এখন ফুল ও সবজি চাষ করছি।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, পলিহাউজের মাধ্যমে যে ফুল চাষ করা হয়, তা শতভাগ রফতানি করা যাবে। এ পদ্ধতিতে ফুল চাষ করলে ফুলের ফলন যেমন ভালো হয়, তেমনি গঠনও ভালো হয়। গদখালী অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন রাষ্ট্রের ডেলিগেটরা আসেন। তারা আমাদের উৎপাদিত ফুলের চাহিদার কথা জানান। তবে শর্ত বেঁধে দেন মানসম্মত ফুল উৎপাদনের জন্য। তিনি আরও বলেন, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের কারণে আমাদের ইচ্ছা থাকলেও শতভাগ রপ্তানিযোগ্য ফুল উৎপাদন করতে পারি না। কিন্তু বিএডিসির এ প্রকল্প আমাদের জন্য সহায়ক। এ পদ্ধতিতে চাষ করে আমরা রফতানিযোগ্য ফুল ও সবজি উৎপাদনে সক্ষম হয়েছি।
ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দীপঙ্কর দাস বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু মোকাবিলায় ফুল ও সবজি চাষের সম্প্রসারণে আধুনিক পলিহাউজ পদ্ধতির উন্নয়নে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কৃষক এ প্রযুক্তিকে ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছেন। তিনি আরও বলেন, ভবিষ্যতে এ প্রযুক্তি জেলার অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়া যায় কি না, সে বিষয়ে কৃষি বিভাগ উদ্যোগ নিয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুব আলম বলেন, উন্নত এ প্রযুক্তি দেশের মধ্যে গদখালীতেই প্রথম চালু করা হয়েছে। পরীক্ষামূলকভাবে প্রকল্পটি চালু হলেও এ অঞ্চলের অনেক কৃষক এখন পলিহাউজে ফুল ও সবজি চাষ করতে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের কারণে বাংলাদেশের কৃষকদের সারা বছরই নানা সমস্যায় পড়তে হয়। এসব দিক বিবেচনা করে এ প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছে। এ পদ্ধতিতে সবজি ও ফুল চাষ করলে যশোরের কৃষি অর্থনীতির চাকা ঘুরে দাঁড়াবে বলে তিনি দাবি করেন। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা যে সফলতা পেয়েছি, এটি এখন আরও বড় আকারে কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। শুধু যশোরই নয়, এ অঞ্চলের অন্যান্য জেলায়ও ফুল ও সবজি চাষে এ উন্নত প্রযুক্তি অনুসরণ করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।
কামরুজ্জামান মনি