শামসুন নাহার: সত্তরের দশকের শুরুতে বৈদেশিক বাণিজ্যসংক্রান্ত নীতিমালায় কিছু পরিবর্তন আসে। মূলত বিভিন্ন ঘটনা ও প্রবণতার পরিপ্রেক্ষিতে প্রায়ই এ ধরনের নিয়মকানুন রদবদল করা হয়। বাহ্যিকভাবে দেখলে বলতে হবে, আইন ভাঙতেন না ধীরুভাই। বরং আইনের অস্পষ্টতা বা ফাঁকফোকরকে খুবই সৃজনশীল উপায়ে ব্যবহার করেছেন। তখন অন্যরাও সে পথ অনুসরণ করা ধরলে সরকারের টনক নড়েছে। তখন তড়িঘড়ি করে বদলাতে হয়েছে আইন। সে সময় ভারতের টেক্সটাইল ব্যবসায় মূল চ্যালেঞ্জ ছিল তন্তু ও সুতার যোগান নিশ্চিত করা। ভারতে সিনথেটিক সুতা উৎপাদনকে অনুৎসাহিত করা হতো। গান্ধীর স্বনির্ভরতা আন্দোলনের প্রভাবে দেশি সুতি কাপড়ের চলই বেশি। তাছাড়া কটন সুতা উৎপাদকদের শক্তিশালী লবিং এ ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান বাধা। অন্যদিকে, সিনথেটিক কাপড়কে ধনীদের পোশাক হিসেবে দেখার প্রবণতা বিদ্যমান। কিন্তু সময়ের সঙ্গে পলিস্টারের জনপ্রিয়তা বাড়ছিল। চকচকে, হালকা ও টেকসই এ কাপড় সহজে পরিষ্কার হয়। পলিয়েস্টারের সঙ্গে কটনের মিক্সড্ কাপড়ও বেশ সাড়া ফেলল।
ভারতে মাত্র কয়েকটি ফ্যাক্টরিতে রেয়ন, নাইলন ও পলিয়েস্টার সুতা তৈরি হতো। তাতে দেশীয় চাহিদার সামান্যই পূরণ হতো। চোরাবাজার বাকিটা জোগান দিতো। চোরাবাজারের সুতা কেনায় ধীরুভাইয়ের ঘোর আপত্তি। তবু পরিস্থিতির কারণে কিছু সুতা কিনতে হয়েছে। দেশে উৎপন্ন সুতার দাম বেশি। চোরাই সুতা অনেক সস্তা। লস ঠেকাতে কিনতেই হতো। ব্যবসায়িক আপস। কিন্তু সেগুলো আলাদা রাখার নির্দেশ দিতেন ধীরুভাই। কিন্তু এভাবে তো চলতে পারে না। পরিকল্পনা করতে থাকেন কিভাবে সুতার আমদানি বাড়ানো যায়। আগেই বলেছি, চাইলেই ইচ্ছেমতো বিদেশি সুতা আমদানি করা যায় না। ফিনিশড্ টেক্সটাইল বা রেডি কাপড় রফতানির বিনিময়ে আমদানির অনুমোদিত সীমা অর্জন করতে হয়। এ কাজে তিনি আগে থেকেই ওস্তাদি দেখিয়েছেন। রেয়ন কাপড় রফতানির পরিমাণ বাড়িয়ে নাইলন ফাইবার আমদানি নিশ্চিত করেছেন। স্কিমের সুযোগ নিয়ে রাতারাতি শুরু করেছিলেন ম্যানুফ্যাকচারিং। আর এবার তো স্বয়ং সরকারই চাপে পড়েছে। বাষট্টিতে চীন ও পঁয়ষট্টিতে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের কারণে ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য যথেষ্টই ভারসাম্য হারিয়েছিল। তাই সত্তরের দশকে এ খাতকে চাঙ্গা করায় খুব গুরুত্ব দেয় সরকার। এটাই মোক্ষম সুযোগ। ১৯৭১ সালে টেক্সটাইল মালিকদের একটি দল টি এ পাইকে খুব করে ধরেন। তাদের দাবি নাইলন রফতানিকারকদের পলিয়েস্টার ফিলামেন্ট সুতা (পিএফওয়াই) আমদানির অধিকার দিতে হবে। ধীরুভাইও ছিলেন সঙ্গে। তিনি বললেন, নাইলন আমদানির লাইসেন্স পাওয়ার পর ভালোমানের কাপড় তৈরি করেছি। আগের চেয়ে দ্বিগুণ দামে রফতানি করেছি। তার পুরস্কার হিসেবে হলেও পলিয়েস্টার আমদানির অনুমতি দেয়া উচিত। এবারও ভালো ফল আসবে, দেখবেন। টেক্সটাইল রফতানি খাত উঠে যাবে।
আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় স্থানীয় পলিয়েস্টার সুতার দাম তখন প্রায় সাত গুণ বেশি। সরকার পক্ষ পরিস্থিতি অনুধাবন করলো। লাইসেন্স দিলে দেশের পলিয়েস্টার সুতা উৎপাদকেরা মার খাবে বটে। কিন্তু আমদানি বাড়লে লাভ আরও বেশি। হয়েছিলও ঠিক তা-ই। হাইয়ার ইউনিট ভ্যালু স্কিম নামে পরিচিতি পেয়েছিল এ লাইসেন্স। যতদিন এ সুবিধা বহাল ছিল তত দিনে পুরো লাভ উসুল করলেন ধীরুভাই। বলতে গেলে তিনি এ স্কিমের সর্বাধিক সুবিধা কাজে লাগিয়েছেন। এর আওতায় পলিয়েস্টার কাপড় রপ্তানির ৬০ শতাংশেরও বেশি করেছিল রিলায়ান্স একাই। কিভাবেÑসে এক গল্প বটে। কাপড় তৈরির ক্ষেত্রে মানের ব্যাপারে কোনো খামতি রাখেনি রিলায়ান্স টেক্সটাইল। এরপর শুরু হলো ‘হাই-প্রোফাইল’ মার্কেটিং। প্রথমে ইউরোপের কিছু ছোট অর্থনীতির দেশকে অ্যাপ্রোচ করা হলো। মূল টার্গেট পোল্যান্ড। ওয়ারশ’তে জাঁকজমকপূর্ণ ফ্যাশন শো হলো। মুম্বাইয়ের পাঁচতারকা হোটেলে পোল্যান্ডের বাণিজ্যিক প্রতিনিধিদের আমন্ত্র্রণ জানিয়ে পার্টি দেওয়া হলো। আরেকটি সম্ভাব্য বড় ক্রেতা সৌদি আরব। জেদ্দায় বসবাসরত এডেনকালের বন্ধুর সহায়তায় সৌদি আরবেও পুরোদমে মার্কেটিং চলল। পাশাপাশি দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ায় ফুলপেজ বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রচার করা হলো, রিলায়ান্সের কাপড় যাচ্ছে বিদেশ!
এরপর নানারকম গুজব ছড়িয়ে পড়ে। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয় খুব। অনেকে বলেন, কেবল আম্বানিকে সুবিধা দেওয়াই ছিল এ স্কিমের মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু এসব গুজব ফুঁয়ে উড়িয়ে দেন ধীরুভাই। বলেন, টেক্সটাইল বিজনেসে যারা আছেন তারা কেউই আমার চেয়ে কিছু কম বুদ্ধিমান নন। সুযোগ সবার জন্যই দেওয়া হয়েছে। এখন তারা যদি চোখ বন্ধ করে বসে থাকে, সুযোগ কাজে না লাগায়, সে তো আমার দোষ নয়।
অন্যদের মতো ধীরুভাই সুযোগের অপেক্ষায় থাকেননি, সুযোগ তৈরি করে নিয়েছেন। তবু কিছু পাল্টা যুক্তি থেকে যায়। ১৯৭১ সালে সরকার এ সুযোগ দেওয়ার আগে কেউই কিছু টের পায়নি। আর স্কিম অনুমোদনের পর ধীরুভাই বলতে গেলে রাতারাতি উৎপাদন, মার্কেটিং, রফতানিÑসব করে ফেললেন। তাতে মনে হয়, পলিয়েস্টার তৈরির জন্য কাঁচামাল, মেশিন, প্রশিক্ষিত জনবল অন্তত বছর দুই থেকেই প্রস্তুত করে রেখেছিলেন তিনি। তাহলে তিনি কি আগে থেকেই জানতেন এ স্কিমের কথা? জানতেই পারেন। সে ক্ষেত্রে অন্য টেক্সটাইল মালিকেরা তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পারবে কেন? অন্যরা প্রস্তুতি নিতে নিতে কয়েকটি চালান পৌঁছে গেছে রিলায়ান্সের। এ বাদেও অন্য গুজব আছে। বিপিন কাপাডিয়া নামে একজন ব্যবসায়ীও তখন পলিয়েস্টার ফিলামেন্ট আমদানির চেষ্টা করেন। অদ্ভুত কারণে ব্যর্থও হন। তিনি দফায় দফায় পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন কে বা কারা তাকে লাইসেন্স না নিতে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। এমনকি টাকার লোভ ও প্রাণের ভয় দেখিয়ে চাপ প্রয়োগ করছে। এর পেছনে আম্বানির হাত ছিলÑএমন কোনো প্রমাণ কাপাডিয়া দেখাতে পারেননি। পুলিশও কিছু খুঁজে পায়নি।
আরও একটি জনশ্রুতি আছে। পলিয়েস্টার ফিলামেন্ট আমদানির লাইসেন্সপ্রাপ্ত কয়েকজন ব্যবসায়ীকে অনাকাক্সিক্ষত ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল। শোনা যায়, মুম্বাইয়ের শুল্ক কালেক্টর আই কে গুজরালকে তাদের বিরুদ্ধে খুঁচিয়ে দেন ধীরুভাই। তারা নি¤œমানের সুতা কিনেছে কিংবা ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার জন্য পণ্যের মূল্য কম দেখিয়েছেÑএ রকম অভিযোগে। সব অভিযুক্ত শিপমেন্ট আটক করে পোর্টে ফেলে রাখা হলো তো হলো। একবছর অব্দি কোনো খোঁজ নেই। ইমপোর্টারদের তাড়ার মুখে গুজরাল নির্বিকার। তদন্ত আজ হয় কি কাল হবে করে সময় গড়াতে থাকে। ওদিকে বাড়তে থাকে ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম। পুরো এক বছর পর গুজরালের বদলে কালেক্টর হয়ে আসেন জে দত্ত। তিনি কারণ দর্শানো নোটিশ দিয়ে এক দিনের শুনানিতে পণ্য খালাস করে দেন। কিন্তু তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। স্কিমের মেয়াদ প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। গোডাউনে পড়ে থেকে সুতার মান খারাপ হয়েছে। তার ওপরে শতগুণ বাড়তি প্রিমিয়াম। বিরাট লোকসান গুনতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের।
১৯৭৭ সালে ইন্দিরা ক্ষমতা হতে অপসারিত হন। তবে তার সরকার ধীরুভাইকে দিয়ে যান এক বিদায়ী উপহার। ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরে ধীরুভাই নিজস্ব রফতানি ও ক্রয় মিলিয়ে মোট তিন কোটি টাকার আরইপি লাইসেন্স অর্জন করেছেন। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার তিন সপ্তাহের মধ্যে বিশেষ তদবির অনুমাদন করে সরকার। আরইপি লাইসেন্সের আওতায় পলিস্টার ফাইবার আমদানিকে শুল্ক হতে অব্যাহতি দেয়া হয়। তখন এ শুল্কের হার ছিল পণ্যমূল্যের ১২৫ শতাংশ। অর্থাৎ, সরকারের একটিমাত্র সিদ্ধান্তে তিন কোটি ৭৫ লাখ টাকা লাভ করলেন ধীরুভাই।
যা হোক, ওই বছরের আগস্টে হাই ইউনিট ভ্যালু স্কিম বাতিল হয়। ততদিনে ভারতের পলিস্টার সুতা আমদানিকে আধিপত্য তৈরি করেছে রিলায়ান্স। ইতালির ইতাল ভিসকোস ও সি ইতোব, জাপানের আসাহি কেমিক্যালস্ ও আমেরিকার ডু পন্টের মতো বড় বড় কোম্পানির প্রধান ভারতীয় আমদানিকারক হয়ে গেলেন ধীরুভাই আম্বানি। ওদিকে কংগ্রেসকে হঠিয়ে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) তখন ক্ষমতায়। সিনথেটিক টেক্সটাইলের বাণিজ্য নীতিতে কিছু পরিবর্তন আনে বিজেপি। এতে সুতা আমদানির একমাত্র লাইসেন্স দাতা হিসেবে দায়িত্ব পায় স্টেট ট্রেডিং করপোরেশন (এসটিসি)। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত টেক্সটাইল রপ্তানির ৬০ থেকে ৭০ ভাগ যেতো আম্বানির নারোদা প্লান্ট থেকে। সরকার রপ্তানিতে নতুন নিয়ম আরোপ করলে ধীরুভাই দেশের মার্কেটে মনোযোগ দেন। সারাদেশে বিমলকে একটি আধুনিক ফ্যাশন ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য উঠেপড়ে লাগলো রিলায়ান্স টেক্সটাইল টিম। ফ্যাশন শো ও টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বিমল। বলিউডের অভিনেতাদের গায়ে বিমলের পোশাক। বাজারে চাহিদা দেখে পাইকাররাও হুমড়ি খেয়ে পড়লো বিমলের কাপড় কেনার জন্য। কিছু কিছু দোকানদার চাইলো তারা শুধুই বিমলের কাপড় বিক্রি করবে। ওনলি বিমল। দারুন একটি আইডিয়া পেয়ে গেলেন আম্বানি। সারা ভারত ছুটে বেড়ালেন বিমলের ডিলার সংগ্রহের জন্য। এরা শুধুই বিমলের কাপড় রাখবে। অর্থাৎ ব্যক্তি মালিকানার এ দোকানগুলোই সারাদেশে বিমলের শো-রুম হিসেবে কাজ করবে। চারশ’টি শোরুম নিয়ে নবযাত্রা শুরু করলো ‘ওনলি বিমল’। বলা যায়, বিমলই আম্বানির পরশপাথর। বিমলের সফলতার পর যা কিছুতে হাত দিয়েছেন তা-ই সফলতা এনে দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাইয়ের ছেলে কান্তিলালের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রেখেছেন আম্বানি। তাতে অবশ্য খুব একটা সুবিধে হয়নি। ঠিক করলেন জনতা পার্টির অবসান ঘটাতে ইন্দিরা গান্ধীকে সাহায্য করবেন। এজন্য জনতা জোটকে ভাঙতে হবে। জনতা পার্টির অর্থমন্ত্রী চৌধুরী চরণ সিংয়ের উচ্চাকাক্সক্ষাকে কাজে লাগানো যায়। তিনি উত্তর প্রদেশের বৃহত্তর কৃষকসমাজের জনপ্রিয় নেতা। তাকে প্রধান করে আলাদা দল গঠনের পাঁয়তারা শুরু হলো। ধীরুভাইয়ের কাজ ছিল সংসদ সদস্যদের বাগে আনতে টাকা ছড়ানো। জনতা দল ছেড়ে চরণ সিংয়ের ছত্রছায়ায় চলে এলেন অনেক নেতা। এতে মোরারজি দেশাইয়ের দল ভেঙ্গে পড়লো। উত্থান হলো চরণ সিংয়ের দল। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ইন্দিরার সহায়তা প্রয়োজন। ইন্দিরা দাবি করলেন, ক্ষমতায় গেলে ইন্দিরা ও তার ছেলে সঞ্জয়ের বিরুদ্ধে জরুরি অবস্থার সময়ে দেয়া মামলা উঠিয়ে নিতে হবে। চরণ সিংয়ের সে ক্ষমতা ছিল না। ১৯৮০ সালের প্রথম সপ্তাহে চরণ সিংয়ের প্রধানমন্ত্রীত্ত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়। নির্বাচনে ক্ষমতায় ফিরে আসে কংগ্রেস। গুজরাটের এমপিরা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাকে সংবর্ধনা দেয়ার জন্য হোটেল অশোকে একটি গ্রান্ড পার্টির আয়োজন করেন। আর এ পার্টির খরচ বহন করেন আম্বানি। শুভাকাক্সক্ষীদের অভ্যর্থনা জানানোর সময় ইন্দিরা ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। সবকিছু পরিকল্পনা মতো হয়েছে। শুভদিন এসেছে আবার। সামনে অপার সম্ভাবনা।