‘এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম গাছের তলে, তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে’। পল্লিকবি জসীমউদ্দীনের ‘কবর’ কবিতার প্রথম দুটি চরণ। সেই কবরটির পাশে কবির নিজের কবরই আজ ভিজে আছে হাজারো দর্শনার্থীর চোখের জলে।
পল্লিকবি ফরিদপুরের তাম্বুলখানা গ্রামে ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক ভিটা তাম্বুলখানার পাশের গ্রাম গোবিন্দপুর। কবির বাল্যকাল ও কৈশোর অতিবাহিত হয়েছে এই গোবিন্দপুরে। গ্রামটি কুমার নদীর তীরে অবস্থিত। কবির বাবার নাম মাওলানা আনছার উদ্দিন মোল্লা। তার নামে গোবিন্দপুর রেলস্টেশনের কাছে একটি হাইস্কুল রয়েছে। কবিরা ছিলেন চার ভাই। বড় ভাই মফিজ উদ্দিন মোল্লা, সেজ ভাই নূরুউদ্দিন আহম্মদ। নূরুননাহার সাজু কবির একমাত্র বোন। তিনি ১৯৭৬ সালে ঢাকায় মারা যান। তাকে পৈতৃক বাড়ির প্রিয় ডালিম গাছতলায় দাফন করা হয়।
কবির বাড়িতে প্রবেশ করতেই পল্লিগ্রামের প্রকৃতি যেন দর্শনার্থীকে অনুভূতি স্পর্শ করে স্বাগত জানায়। চারদিকে গাছপালা, বাগান, কবির সমাধিক্ষেত্র, মাঠ, পাখির কিচিরমিচির শব্দ। কবির বাড়ির আঙিনায় চারটি দোচালা টিনের ঘর রয়েছে। কবির ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র ঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। বারান্দায় ছোট ছোট পাটের ছিকা রয়েছে। ভেতরে নকশা করা মাটির রঙিন কলস রাখা আছে।
কবির স্মৃতিঘরে বিভিন্ন মুহূর্তের ছবি তুলে চার দেয়ালে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। তার ব্যবহƒত নানা জিনিসের মধ্যে কাঠের আলমারি থেকে শুরু করে আছে একটি সুন্দর পালকিও। স্মৃতিঘরের দুটি আলমারিতে সাজানো অসংখ্য মাটির পুতুল সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে দর্শনার্থীদের।
কবির বিভিন্ন লেখা বাড়ির চত্বরে প্রদর্শন করা হয়েছে। বাড়ির পূর্ব ও পশ্চিমে পড়শিদের বসতবাড়ি এবং দক্ষিণে ছোট একটি পুকুর রয়েছে।
কবি জীবদ্দশায় অনেক গাছ লাগিয়েছিলেন। গাছগুলো এখন বেশ বড় হয়েছে। পুরো বাড়িটিই যেন প্রকৃতির প্রতি কবির মমত্ববোধের প্রতিচ্ছবি।
বাড়ির উত্তরে কবির কবরস্থান। কবরস্থানের পাশে পাকা রাস্তা ও কুমার নদী। তার পাশে শায়িত রয়েছেন কবির বাবা আনছার উদ্দিন মোল্লা, মা আমেনা খাতুন, কবিপতœী বেগম মমতাজ জসীমউদ্দীন, বড় ছেলে কামাল আনোয়ার (হাসু), বড় ছেলের স্ত্রী জরিনা, কবির বড় ভাই মফিজ উদ্দিন মোল্লা, সেজো ভাই সাঈদ উদ্দিন আহম্মদ মোল্লা, ছোট ভাই প্রফেসর নুরুদ্দিন আহম্মদ, ছোট বোন নূরুন নাহার (সাজু), নাতি আসিফ, সেজো ভাইয়ের মেয়ে হোসনে আরা (দোলন), সেজো ভাইয়ের নাতনি মনজুরা শাহরিন (চাঁদনী) ও কবির শিশু ভাগনীর কবর।
কবির জন্মভিটায় প্রতি বছরের ১ জানুয়ারি জসীম মেলা বসে। চলে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত। মেলার প্রধান আকর্ষণ পল্লিগীতি ও বিচার গানের আসর। মেলায় থাকে ফরিদপুরের ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটি, মাটির হাঁড়ি, পুতুল, লোহা, বাঁশ ও বেতের নানা সামগ্রী। খাবারের মধ্যে থাকে বৈচিত্র্যময় মিষ্টি, ঝাল পেঁয়াজু, মোগলাই, সিঙাড়া, পুরি প্রভৃতি। মেলা ঘিরে পুতুলনাচ ও মৃত্যুকূপ সার্কাসের আয়োজন করা হয়। মেলায় কবির জীবনী নিয়ে আলোচনা সভা ও কবিতা আবৃত্তির আসর বসে।
এ বাড়ির বাইরে একটি পর্যটন স্পট রয়েছে। সেখানে বিকালে অনেক মানুষের সমাগম ঘটে। পাশে রয়েছে একটি মাঠ। দর্শকের বসার জন্য মাঠের পাশে ব্যবস্থা রয়েছে।
কীভাবে যাবেন
ফরিদপুর বাসস্ট্যান্ড হতে দুই কিলোমিটার দূরে পল্লিকবির বসতবাড়ি ও কবরস্থান। রিকশা, অটোরিকশা কিংবা মাইক্রোবাসে যাওয়া যায়।
আবাসন ব্যবস্থা
দর্শনীয় স্থানে কোনো আবাসনের ব্যবস্থা নেই। তবে ফরিদপুর শহরে আবাসনের ব্যবস্থা রয়েছে।
শিপন আহমেদ