ফারুক আলম, লালমনিরহাট: লাম্পি স্কিন (এলএসডি) একটি ভাইরাসজনিত রোগ। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি বাংলাদেশে প্রথম চট্টগ্রামে এ রোগ দেখা দেয়। পরে ছড়িয়ে যায় সারাদেশে। চার বছর ধরে খামারিদের কাছে রীতিমতো আতঙ্কের নাম এ রোগ। পশুচিকিৎসকের মতে, এ রোগের এখন পর্যন্ত কোনো চিকিৎসা বা প্রতিষেধক নেই। তবুও বিভিন্ন ক্ষেত্রে পল্লিচিকিৎসকরা ব্যবহার করছেন অ্যান্টিবায়োটিক মতো ওষুধ। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রান্তিক খামারিরা।
পশু চিকিসৎকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লাম্পি স্কিন রোগ হলে প্রথমে পশুর শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, পশুর খাবারের রুচি কমে যায় এবং জ্বর বেশি হলে নাক-মুখ দিয়ে লালা বের হয়। শরীরের বিভিন্ন স্থানে চামড়ায় গুটি গুটি ক্ষত হয় এবং কখনও কখনও দুই পায়ের মাঝে বুকের নিচে পানি জমতে পারে। লাম্পি স্কিন রোগের এখন পর্যন্ত কোনো চিকিৎসা বা প্রতিষেধক নেই। আক্রান্ত পশুকে ঘনঘন স্যালাইন পানি, বেশি বেশি কাঁচা ঘাস খাওয়াতে হবে। শরীরে জ্বর বেড়ে গেলে প্যারাসিটামলজাতীয় ওষুধ খাওয়ানো যেতে পারে। তবে এগুলো কোনোটিই ভাইরাস রোগের চিকিৎসা নয়। এ রোগে আক্রান্ত পশুর মৃত্যুঝুঁকি খুবই কম। এ সংখ্যা আক্রান্ত পশুর শতকরা পাঁচ শতাংশ। তবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও বাছুর গরুর মৃত্যুঝুঁকি একটু বেশি থাকে। সাধারণত ১৪ দিন থেকে সর্বোচ্চ এক মাস সময় লাগে এ রোগ থেকে ভালো হতে।
জানা যায়, উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে পর্যাপ্ত লোকবল না থাকার কারণে খামারিদের ভরসা হয়ে উঠছেন পল্লীচিকিৎসক কিংবা খুব বড়জোর ইউনিয়ন কর্মকর্তা (ভিএফএ)। এতে গরুপ্রতি পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা খরচ করে গরুকে কোনো রকম সুস্থ করা গেলেও চিহ্ন থেকে যাচ্ছে, কিছু ক্ষেত্রে গরু মারাও যাচ্ছে। এতে সহায়-সম্বল হারাচ্ছেন প্রান্তিক মানুষজন, লোকসানে পড়ছেন ছোট ও বড় খামারিরা।
আদিতমারী উপজেলার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খামারি জানান, খামার করবেন বলে এ বছর শেড করেছেন। একটি গরু কিনেছেন ৩৩ হাজার টাকা দিয়ে। সেই গরুটাই লাম্পি স্কিন ডিজিসে আক্রান্ত হয়। স্থানীয় পল্লীচিকিৎসকের কাছে তিন হাজার টাকা খরচ করে চিকিৎসা করান। একপর্যায়ে গরুটির অবস্থা খারাপ হলে কসাই ডেকে ২৫ হাজার টাকা লস করে সাড়ে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি করেন।
একটি কৃষি ইনভেস্ট কম্পানির ফিল্ড সুপারভাইজার আব্দুল আহাদ জানান, প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে খামারিরা কোনো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না। কোনো প্রচারণাও নেই। যে যার মতো যা ইচ্ছা অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছেন। ছোট একটি বাছুরের চিকিৎসা করাতে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা চলে যাচ্ছে।
লালমনিরহাট সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সাজিয়া আফরিন বলেন, ‘লেবু, গুড়, নিমপাতা ও সোডার দ্রবণে মাঠ পর্যায়ে ভালো ফল পাওয়া গেছে। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করছি না। বড় গরু আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা কম। ছোট গরুর ইমিউনিটি কম হওয়ায় দ্রুত আক্রান্ত হয়। দুই শতাংশের মতো মৃত্যু হতে পারে।’
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে জাত নিম পাতা, সোডা, লেবু ও প্যারাসিটামলের কথাই এখন পর্যন্ত বলা আছে। প্রথম অবস্থায় কোনো প্রকার অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যাবে না। যে গরুকে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হবে, সেটাই দুর্বল হতে হতে মারাও যেতে পারে। যেসব পল্লি চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করছেন, তাদের তাৎক্ষণিকভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। উপজেলাগুলোয় মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে।’
রংপুর বিভাগের ভেটেরিনারি পাবলিক হেলথের উপপরিচালক ডা. আবু ছাঈদ বলেন, ‘গোট পক্সের ভ্যাকসিন লাম্পির জন্য দিলে কাজ হবে। কিছু ক্ষেত্রে কাজ না হলেও তীব্রতা কম হবে। লাম্পির নির্দিষ্ট কোনো ভ্যাকসিন আমরা এখনও পাইনি। কোনো কোম্পানির প্ররোচনায় ভ্যাকসিন নিলে খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। লাম্পির প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্টেজ আছে। কোনো অবস্থাতেই লাম্পি আক্রান্ত গরু জবাই করা যাবে না। এমন গরু মারা গেলে পুঁতে ফেলতে হবে। কেউ জবাই করে বিক্রি করলে আইনের আওতায় আনতে হবে। আক্রান্ত গরুর মাংস খেলে মানুষের ক্ষতি হবে কি না, এমন কোনো তথ্য আমাদের হাতে পৌঁছায়নি। ভাইরাস আক্রান্ত মাংস খাওয়া যাবে না।’