Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 11:34 am

পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের একে একে ঢাকা ত্যাগ

কাজী সালমা সুলতানা: ২৪ মার্চ, ১৯৭১। আজ উত্তাল ২৪ মার্চ, যেদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে বাঙালির মুক্তির আন্দোলনকে থামিয়ে দিতে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। বাঙালিরা পরিষ্কারভাবে অনুধাবন করতে পারছিল পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের কাঠামোতে দৃশ্যত পূর্ব পাকিস্তান আর নেই। এটি এখন স্বাধীন বাংলাদেশ।

এ বাংলাদেশের জন্য এখন শুধুই প্রয়োজন স্বাধীনতার ঘোষণা। প্রতিদিনের মতো আজও তাই আন্দোলনকারী বীর বাঙালির সব মিছিলের ঠিকানা ছিল ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন। হাজার হাজার জনতা মিছিল করে আসে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সমাগত মিছিলকারীদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় বিরামহীনভাবে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, আর আলোচনা নয়, এবার ঘোষণা চাই। তিনি বলেন, আগামীকালের মধ্যে সমস্যার কোনো সমাধান না হলে বাঙালিরা নিজেদের পথ

নিজেরাই বেছে নেবে। আমরা সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ। কোনো ষড়যন্ত্রই আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না। সরকারের প্রতি তিনি হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, বাংলার জনগণের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হলে তা বরদাস্ত করা হবে না।

এদিকে ২৩ মার্চ রাত থেকে ২৪ মার্চ সকাল পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সৈয়দপুর সেনানিবাসের পার্শ্ববর্তী বোতলাগাড়ি, গোলাহাট ও কুন্দুল গ্রাম ঘেরাও করে অবাঙালিদের সঙ্গে নিয়ে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। এতে ১০০ জন নিহত হন এবং এক হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হন। শহরে কারফিউ দিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্য ও আবাঙালিরা সম্মিলিতভাবে বাঙালিদের বাড়িঘরে আগুন দেয় এবং হত্যাযজ্ঞ চালায়।

রংপুর হাসপাতালের সামনে ক্ষুব্ধ জনতা ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে এদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রংপুর সেনানিবাস-সংলগ্ন এলাকায় নিরস্ত্র অধিবাসীদের ওপর বেপরোয়াভাবে গুলিবর্ষণ করে। এতে কমপক্ষে ৫০ জন নিহত ও বহু আহত হন। 

চট্টগ্রামে পাকিস্তানি সেনারা নৌবন্দরের ১৭নং জেটিতে নোঙর করা এমভি সোয়াত জাহাজ থেকে সমরাস্ত্র খালাস করতে গেলে প্রায় ৫০ হাজার বীর বাঙালি তাদের ঘিরে ফেলে। শ্রমিকদের কোনো সহায়তা না পেয়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরাই জাহাজ থেকে কিছু অস্ত্র খালাস করে ১২টি ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়ার সময় জনতা পথ রোধ করে। এই ব্যারিকেড সৃষ্টিকারী জনতার ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নির্বিচারে গুলি চালালে ২০০ শ্রমিক শহিদ হন।

গত দিনের মতো এদিনও সারা বাংলাদেশে অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন ভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিল। ইস্ট বেঙ্গল ও পাকিস্তান রাইফেলসের যশোর ট্রাংক রোডের অফিসেও এদিন উড়ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।

এদিকে মিরপুরে সাদা পোশাকধারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতায় অবাঙালিরা বাঙালিদের বাড়িঘরের শীর্ষে ওড়ানো বাংলাদেশের পতাকা ও কালো পতাকা জোর করে নামিয়ে তাতে আগুন দেয় এবং পাকিস্তানের পতাকা তোলে। রাতে এ এলাকার বাঙালিদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে অবাঙালিরা এখানে ব্যাপক বোমাবাজি করে।

এদিন সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে আওয়ামী লীগ ও সরকারের উপদেষ্টা পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন উপস্থিত ছিলেন। প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের মধ্যে ছিলেন এম এম আহম্মদ, বিচারপতি এআর কর্নেলিয়াস, লে. জেনারেল পীরজাদা ও কর্নেল হাসান। দু’ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক শেষে তাজউদ্দীন আহমদ উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেয়া শেষ। এখন প্রেসিডেন্টের উচিত তার ঘোষণা দেয়া। তিনি বলেন, আজ প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, আলোচনা অনির্দিষ্টকাল চলতে পারে না। আওয়ামী লীগ আলোচনা আর দীর্ঘায়িত করতে প্রস্তুত নয়।

এদিকে ইয়াহিয়া খানের আমন্ত্রণে পাকিস্তান থেকে খান আবদুল কাইয়ুম খান ঢাকায় আসেন। কাইয়ুম ঢাকা আসার পরই ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে বৈঠকে বসেন। পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো দুপুরে প্রেসিডেন্ট ভবনে জেনারেল ইয়াহিয়া ও তার উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠক শেষে ভুট্টো সাংবাদিকদের বলেন, পূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি অত্যন্ত করুণ ও দুর্ভাগ্যজনক। এ অঞ্চলের শোষিত জনগণের প্রতি আমার অনেক ভালোবাসা রয়েছে। আমি তাদের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করছি, কিন্তু আমার একটি জাতীয় দায়িত্ব রয়েছে। আমি পাকিস্তান অখণ্ড রাখার জন্য জীবন দান করতে প্রস্তুত।

টিভি কেন্দ্রে প্রহরারত সৈন্যরা টেলিভিশন কর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলে সন্ধ্যা থেকে ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রের কর্মীরা সব ধরনের অনুষ্ঠান সম্প্রচার থেকে বিরত থাকেন। স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা এক বিবৃতিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র গণবিপ্লবকে আরও জোরদার করার জন্য সংগ্রামী বাংলার ব্যাপক জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।

সাংবাদিকরা এক জরুরি সভায় মিলিত হয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সেনাবাহিনীর সদস্যদের হয়রানিমূলক আচরণের তীব্র নিন্দা জানান।

এদিন ঢাকায় অবস্থানকারী পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা একে একে ঢাকা ত্যাগ করতে শুরু করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের ছোট ছোট পার্লামেন্টারি দলের সব নেতাই এদিন করাচির উদ্দেশে ঢাকা ছেড়ে চলে যান। ভুট্টোর সফরসঙ্গীর ১৩ জনের সাতজনই এদিন ঢাকা ত্যাগ করেন।

তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, মূলধারা ৭১