মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: পতনের বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না পুঁজিবাজার। নতুন বছরে বাজার ঘুরে দাঁড়াবে এমন প্রত্যাশা অপেক্ষা করলেও বিনিয়োগকারীরা এর উল্টো ফল পাচ্ছেন। প্রতিদিনই দেখতে হচ্ছে বড় বড় পতন। শেষ হওয়া সপ্তাহে প্রতিদিনই সূচকের পতন হচ্ছে এক শতাংশের বেশি। টানা পতনে গত পাঁচ দিনে ডিএসইতে সূচকের রেকর্ড পতন হয়েছে। ২০১০ সালের পরে টানা পাঁচ দিন এ ধরনের পতন আর দেখা যায়নি। এতে বাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের দুশ্চিন্তা আরও বেড়েছে।
শেষ হওয়া সপ্তাহের পাঁচ দিনে ডিএসই প্রধান সূচকের পতন হয়েছে ২৬৩ পয়েন্ট। সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে সূচকের পতন হয় ৫৯ পয়েন্ট। পরের কার্যদিবসে পতন আরও বড় হয়। এদিন সূচক হ্রাস ৭০ পয়েন্ট। পরের কার্যদিবসে সূচক কমে প্রায় ৫০ পয়েন্ট। এর পরের দিন সূচক কমে ৫৩ পয়েন্ট। এই চার কার্যদিবসেই সূচকের পতন ঘটে এক শতাংশের বেশি। সর্বশেষ গতকাল সূচকের পতন হয় ৩১ পয়েন্ট। সূচকের এই পতনও ছিল এক শতাংশের কাছাকাছি।
এদিকে এই ধরনের পতনকে ভয়ের কারণ বলে মনে করছেন পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, একদিনে এক শতাংশের বেশি পতন পুঁজিবাজারের জন্য ভালো লক্ষণ নয়। যদিও বছরের শুরুতেই বাজার উন্নয়নে কিছু প্রস্তাবনা নিয়ে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে ডিএসই কর্তৃপক্ষ। তবে এসব প্রস্তাবের কোনো প্রতিফলন বাজারে দেখা যায়নি।
এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্ট ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া প্রতিদিন এক বা দুই শতাংশ সূচকের পতন হলে তাকে অবশ্যই বড় পতন বলে। বর্তমানে পুঁজিবাজারে বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। সবমিলে বিনিয়োগকারীদেরও আস্থার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যে কারণে এই ধরনের বড় পতন দেখা যাচ্ছে।
সূত্রমতে, ২০১০ সালে পুঁজিবাজারের অবস্থা যখন টালমাটাল, তখন কিছুদিন সূচকের বড় পতন দেখা গেছে। সে বছর ৫ ডিসেম্বর প্রধান সূচকের পতন হয় ৬০০ পয়েন্ট। তারপর বড় বড় পতন দেখা গেলেও টানা পাঁচ কার্যদিবস এই ধরনের পতন দেখা যায়নি। সংশ্লিষ্টদের মতে, তখন সূচক পতনের উল্লেখযোগ্য কারণ ছিল। কিন্তু এখন পুঁজিবাজারের সেই পরিস্থিতি নেই। ফলে এই পতন আরও অস্বাভাবিক।
এদিকে পতনের জের ধরে লেনদেনও তলানিতে নেমে এসেছে। ২০১০ সালে বড় পতনের মধ্যেও ৬০০ থেকে এক হাজার কোটি টাকা লেনদেন দেখা গেছে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাজারে প্রায় শতখানিক কোম্পানি ও ফান্ডের তালিকাভুক্তি ঘটেছে। সেই নিয়ম অনুযায়ী লেনদেন আরও বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমান আশঙ্কাজনকহারে লেনদেন হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে লেনদেন ঘুরপাক খাচ্ছে ৩০০ কোটি টাকার ঘরে। গতকালও ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৩০১ কোটি টাকার শেয়ার ও ইউনিট।
এদিকে গত পাঁচ দিনের পতনে আশঙ্কাজনকহারে কমে গেছে বাজার মূলধন। প্রতিদিনই বাজার মূলধন কমেছে তিন থেকে চার হাজার কোটি টাকা। পাঁচ কার্যদিবস আগে ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল তিন লাখ ৪০ হাজার ৮১১ কোটি টাকা। গতকাল তা তিন লাখ ২৩ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। অর্থাৎ পাঁচ দিনে বাজার মূলধন কমেছে ১৭ হাজার কোটি টাকার বেশি।
বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে দেখা যায়, প্রতিদিনই উধাও হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি। হাতেগোনা কিছু প্রতিষ্ঠান ছাড়া একযোগে কমছে তালিকাভুক্ত সব খাতের শেয়ারের দর, যার জের ধরে আশঙ্কাজনকহারে কমে গেছে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বাজার মূলধন। গতকাল এক দিনেই বাজার মূলধন কমে গেছে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি। এর আগের দিনও বাজার মূলধন কমে তিন হাজার কোটি টাকা।
বিনিয়োগকারীরা বলেন, যাদের পুঁজিবাজার নিয়ে ভাবার কথা, আসলে এ নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। তারা চান না পুঁজিবাজার স্থিতিশীল হোক, যে কারণে দীর্ঘমেয়াদি অপেক্ষা করেও আমরা কোনো ফল পাচ্ছি না। দিন দিন পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাসেল আহমেদ নামে এক বিনিয়োগকারী বলেন, ‘প্রতিনিয়ত পতন মোকাবিলা করতে করতে আমাদের অবস্থা করুণ। সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজারে নীরব পতন চলছে। যে কারণে প্রতিদিনই আমাদের লাভের বদলে লোকসানের হিসাব করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, এই পতন চলমান থাকলে আমাদের পথে বসা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।’
এদিকে বাজার পরিস্থিতি ঠিক করার জন্য পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে সরকার। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মাকসুরা নূরকে কমিটির সমন্বয় করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন নির্বাহী পরিচালক, বিএসইসির একজন নির্বাহী পরিচালক এবং আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উপসচিব নাহিদ হোসেন। এই কমিটি গঠানের সিদ্ধান্ত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে হলেও সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে কথা বললে বিনিয়োগকারীরা জানান, নামমাত্র কমিটি গঠন করে কোনো লাভ নেই। ২০১০ সাল থেকে আমরা বহু কমিটি দেখেছি, যার কিছুই কাজে আসেনি। পুঁজিবাজারের উন্নয়ন করতে হলে সবার আগে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ব্রোকারেজ হাউসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বর্তমানে পুঁজিবাজারে তারল্য সংকট চলছে, এটা সৃষ্টি হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের জন্য। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে দেখা যায় বাজার খারাপ হলে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কিনে সাপোর্ট দেন। কিন্তু আমাদের দেশে এর উল্টো। এখানে সবাই ব্যবসা করতেই মগ্ন। যে কারণে দীর্ঘদিন থেকে বাজার স্বরূপে ফিরতে পারছে না।