পাঁচ বছরে ভর্তুকি-প্রণোদনা বাবদ ব্যয় বেড়ে চারগুণ!

বিশেষ প্রতিনিধি: বাজেটে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা দিয়ে থাকে সরকার। তবে ভর্তুকির এ পরিমাণ নিয়ে রয়েছে নানামুখী হিসাব-নিকাশ। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ নেয়ার জন্য বর্তমানে ভর্তুকি কমিয়ে আনতে চাচ্ছে সরকার। তবে গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন খাতে প্রদত্ত ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ ব্যয় বেড়ে প্রায় চার গুণ হয়েছে। এছাড়া সরকারের পরিচালন ব্যয়ের অনুপাতেও ভর্তুকি ব্যয় প্রতি বছর বাড়ছে।

যদিও ভর্তুকির হিসাব নিয়ে রয়েছে লুকোচুরি। মূলত বাজেটে ভর্তুকির পূর্ণাঙ্গ হিসাব প্রকাশ করা হয় না। বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকির তথ্য গত তিন বছর ধরে প্রকাশ করা হচ্ছে না। তবে বিদ্যুৎ খাত এবং তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিতে বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে সরকার।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ভর্তুকির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কৃষি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। আবার কৃষি খাতের ভর্তুকির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সার। বিদ্যুৎ, কৃষি উপকরণ, উন্নত মানের বীজ কেনায়ও কৃষকদের ভর্তুকি দেয়া হয়। এছাড়া কম মূল্যে খাদ্য বিতরণের জন্য খাদ্য খাতেও সরকার পৃথক ভর্তুকি দেয়। আর প্রণোদনা দেয়া হয় পাট ও পোশাক রপ্তানি খাত এবং দেশে প্রবাসী আয় আনার ক্ষেত্রে।

গত পাঁচ বছরের বাজেটের সংক্ষিপ্তসার ও মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছর সর্বোচ্চ ভর্তুকি ছিল বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে। তবে এর পরের বছর থেকে জনপ্রশাসন খাতে সর্বোচ্চ ভর্তুকি ও প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছে সরকার। যদিও জনপ্রসাশন খাতে বরাদ্দের বড় অংশই প্রণোদনা। আর ভর্তুকির জন্য সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পাচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।

তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ভর্তুকি ও প্রণোদনায় সরকার ব্যয় করে ৩৩ হাজার ৫০ কোটি টাকা, যা সরকারের ওই বছরের পরিচালন ব্যয়ের ১৩ দশমিক ৭৩ শতাংশ। এ ব্যয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল পিডিবিকে; যার পরিমাণ ছিল সাত হাজার ৭৬৬ কোটি টাকা। ওই অর্থবছর কৃষিতেও প্রায় সমপরিমাণ ভর্তুকি দেয়া হয়, যার পরিমাণ ছিল সাত হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা। আর খাদ্যে ভর্তুকি দেয়া হয় ছয় হাজার ৬৩০ কোটি টাকা।

এর বাইরে জনপ্রশাসন খাতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা দেয়া হয় চার হাজার ৪৫০ কোটি টাকা, গ্যাস ও অন্যান্য খাতে ভর্তুকি দেয়া হয় দুই হাজার ৫১৪ কোটি টাকা, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতে তিন হাজার ৫১ কোটি টাকা এবং জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা খাতে ৬৬৪ কোটি টাকা। এছাড়া শিল্প ও অর্থনৈতিক সার্ভিস খাতে ১৮ কোটি এবং পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়।

২০১৯-২০ অর্থবছরে ভর্তুকি ও প্রণোদনায় সরকার ব্যয় করে ৩৬ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা, যা সরকারের ওই বছরের পরিচালন ব্যয়ের ১৪ দশমিক ১৭ শতাংশ। এ ব্যয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল জনপ্রসাশন খাতকে, যার পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা। ওই অর্থবছর পিডিবিকে ভর্তুকি দেয়া হয় সাত হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা। কৃষিতেও কাছাকাছি ভর্তুকি দেয়া হয় ওই অর্থবছর, যার পরিমাণ ছিল সাত হাজার ১৭৫ কোটি টাকা।

এর বাইরে খাদ্যে ভর্তুকি দেয়া হয় চার হাজার ১৭০ কোটি টাকা, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতে তিন হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা, গ্যাস ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাতে তিন হাজার ৫১৬ কোটি টাকা এবং জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা খাতে ২৯৯ কোটি টাকা।

২০২০-২১ অর্থবছরে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ সরকার ব্যয় করে ৪৫ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা, যা সরকারের ওই বছরের পরিচালন ব্যয়ের ১৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এ ব্যয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল জনপ্রসাশন খাতকে, যার পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ২০ কোটি টাকা। ওই অর্থবছর পিডিবিকে ভর্তুকি দেয়া হয় আট হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। আর কৃষিতে ভর্তুকি দেয়া হয় সাত হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা।

আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম বাড়তে থাকায় ওই অর্থবছর গ্যাস ও অন্যান্য খাতে ভর্তুকি বাড়ানো হয়; যার পরিমাণ ছিল পাঁচ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। এর বাইরে খাদ্যে ভর্তুকি দেয়া হয় তিন হাজার ৬৬০ কোটি টাকা। সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতেও কাছাকাছি ভর্তুকি-প্রণোদনা দেয়া হয়, যার পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৬২৪ কোটি টাকা। আর জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা খাতে ভর্তুকি-প্রণোদনা দেয়া হয় ৮৫৯ কোটি টাকা এবং প্রতিরক্ষা খাতে ৫০৩ কোটি টাকা।

২০২১-২২ অর্থবছরে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ সরকারের ব্যয় এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় ৭০ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা, যা সরকারের ওই বছরের পরিচালন ব্যয়ের ২১ দশমিক ৯২ শতাংশ। ওই অর্থবছর ভর্তুকি-প্রণোদনা বাবদ ব্যয় ২৫ হাজার ২৬ কোটি টাকা বেড়েছে। বরাবরের মতো ওই অর্থবছরও ভর্তুকি-প্রণোদনায় সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়া হয় জনপ্রসাশন খাতকে, যার পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ২০৪ কোটি টাকা। আর কৃষিতে ভর্তুকি দেয়া হয় ১৫ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা এবং পিডিবিকে দেয়া হয় ১১ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা।

আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর ২০২০-২১ অর্থবছরও গ্যাস ও অন্যান্য খাতে ভর্তুকি বেশি দিতে হয়, যার পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা। এর বাইরে খাদ্যে ভর্তুকি দেয়া হয় চার হাজার ৬৪১ কোটি টাকা। সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতেও একই সমান ভর্তুকি-প্রণোদনা দেয়া হয়। আর জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা খাতে ভর্তুকি-প্রণোদনা দেয়া হয় ৪০৪ কোটি টাকা এবং প্রতিরক্ষা খাতে ৫৭০ কোটি টাকা।

এদিকে চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছরও ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ সরকারের ব্যয় অনেক বেড়েছে। চলতি অর্থবছর এ খাতে ব্যয় (সংশোধিত) ধরা হয়েছে এক লাখ ২৮ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা, যা সরকারের পরিচালন ব্যয়ের ৩০ দশমিক ৭৯ শতাংশ। অর্থাৎ সংশোধিত হিসাবে ভর্তুকি-প্রণোদনা বাবদ ব্যয় ৫৮ হাজার ১৯১ কোটি টাকা বা ৮২ দশমিক ১৯ শতাংশ বেড়েছে।

চলতি অর্থবছরও সংশোধিত হিসাবে ভর্তুকি-প্রণোদনায় সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়া হয় জনপ্রসাশন খাতকে, যার পরিমাণ ছিল ৪৪ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা। আর কৃষিতে ভর্তুকি দেয়া হয়েছে ২৬ হাজার ৬৯৩ কোটি টাকা। এছাড়া পিডিবিকে সংশোধিত হিসাবে ভর্তুকি দেয়া হয়েছে ২৩ হাজার কোটি টাকা এবং গ্যাস ও অন্যান্য খাতে ২১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।

এর বাইরে খাদ্যে ভর্তুকি দেয়া হয় ছয় হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতেও ভর্তুকি-প্রণোদনা বাবদ বরাদ্দ দেয়া হয় চার হাজার ৮০০ কোটি টাকা। আর জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা খাতে ভর্তুকি-প্রণোদনা দেয়া হয় এক হাজার ১৯৯ কোটি টাকা এবং প্রতিরক্ষা খাতে ৬৪০ কোটি টাকা।

প্রসঙ্গত, আগামী অর্থবছর ভর্তুকির পরিমাণ কত হবে, তার পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রস্তাবিত বাজেটে তুলে ধরা হয়নি। তবে এর পরিমাণ মোটামুটি অপরিবর্তিত থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০