Print Date & Time : 30 June 2025 Monday 11:52 pm

পাঁচ বছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়েছে ৬৭ গুণ

সঞ্চয়পত্র থেকে লাগামহীন ঋণ নিচ্ছে সরকার। এ প্রবণতা ঝুঁকি ও বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করছে অর্থনীতিতে, নিয়মিতই যার সমালোচনা করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারপরও সরকার এ বিষয়ে নীতিনির্ধারণী কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। সঞ্চয়পত্র থেকে ঢালাও ঋণ নেওয়া এবং অর্থনীতিতে এর সম্ভাব্য প্রভাব বিশ্লেষণ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন তথ্য নিয়ে অনুসন্ধান করেছে শেয়ার বিজ। এ নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ ছাপা হচ্ছে প্রথম পর্ব

শেখ আবু তালেব: দেশের সরকারি ঋণ ব্যবস্থাপনার মূলনীতিই নির্ধারণ করা হয়েছে কম ব্যয় ও কম ঝুঁকিভিত্তিক। এ জন্য সরকার প্রয়োজন হলে কম সুদে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে রাষ্ট্রীয় এ নীতিমালার বিপরীতে উচ্চ সুদে জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি করেছে সরকার। উচ্চ সুদের এ ঋণ দিয়ে অনুৎপাদনশীল খাত ও ব্যাংকের সুদ পরিশোধ করছে সরকার। এতে সরকারের সুদ ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি পালন হচ্ছে না। এতে গত পাঁচ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বৃদ্ধি পেয়েছে ৬৭ গুণ।
এ সময়ে বাজেট অর্থায়নে সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরশীলতা শূন্য থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৬০ শতাংশে উপনীত হয়েছে, যা সরকারি মোট ঋণের ১৫ শতাংশ থেকে এক-তৃতীয়াংশে পরিণত হয়েছে। জিডিপির হিসাবে দ্বিগুণ হয়েছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। বিষয়টিতে এখনই হস্তক্ষেপ না করলে দেশের ঋণ ব্যবস্থাপনা ও দীর্ঘমেয়াদের দেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। একইসঙ্গে প্রশ্ন তুলেছে সুবিধাভোগীদের সামাজিক মর্যাদা নিয়ে। সংস্থাটির সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
অপরদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক সভার পর্যালোচনায় উঠেছে, সঞ্চয়পত্রে সরকারের ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি ঋণ ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্যহীনতা ও মারাত্মক চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। বিশ্লেষকরা দীর্ঘদিন ধরে এ খাতে সংস্কারের দাবি জানিয়ে এলেও সরকারি নীতিনির্ধারকরা তা গুরুত্ব দিচ্ছেন না। আইএমএফের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এখনই সঞ্চয়পত্র ব্যবস্থাপনায় দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রসঙ্গত, সামাজিক নিরাপত্তার অংশ হিসেবে বিশেষ কিছু জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ আর্থিক সুবিধা দিতে ব্যাংকের চেয়ে উচ্চ সুদের সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের ব্যবস্থা করে রাষ্ট্র। স্বল্প আয়, বয়োজ্যেষ্ঠ, প্রতিবন্ধী ও অবসরে যাওয়া ব্যক্তিরা এর অন্তর্ভুক্ত। এ জন্য ব্যক্তিগতভাবে একজনের সর্বোচ্চ বিনিয়োগ সীমা ৩০ লাখ ও পারিবারিকভাবে সর্বোচ্চ ৬০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে পারবে সঞ্চয়পত্রে।
ব্যাংক খাত তখনও উন্নত না হওয়ায় এ ব্যবস্থার প্রচলন করা হয়েছিল। প্রতি বছর বাজেটে অভ্যন্তরীণ উৎস হিসেবে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়। কিন্তু সামাজিক নিরাপত্তার অংশ হওয়ায় প্রতি বছর কী পরিমাণ সঞ্চয়পত্র বিক্রি হবে তার কোনো লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় না। ফলে সঞ্চয়পত্র বিক্রির ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। চাহিদা অনুযায়ী কিনতে পারে মানুষ।
বাজেট বাস্তবায়ন ও প্রয়োজন হলেই দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস হিসেবে ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত খাতের বিভিন্ন জায়গা থেকে ঋণ নেয় সরকার। জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রি একটি বড় উৎস। ব্যাংক খাত থেকে যেখানে সরকার দুই দশমিক ৪৯ থেকে সাড়ে আট শতাংশ টাকার সুুদে ঋণ নিতে পারে সরকার। অপরদিকে জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নিলে ১০ থেকে ১২ শতাংশ সুদ দিতে হয়। দুই বছর আগে এ হার ছিল সর্বোচ্চ ১৪ শতাংশ পর্যন্ত।
আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকেই সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে অস্বাভাবিকভাবে। মূলত ওই সময়ে ব্যাংক খাতে আমানতের বিপরীতে সুদের হার কমে যাওয়ায় সঞ্চয়পত্র বিক্রি বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ওই অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৭০ কোটি টাকা। পাঁচ বছর পরে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬৭ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।
জাতীয় বাজেটে চলতি অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৬০ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল সরকারের। ব্যাংক খাত থেকে ২৮ হাজার ২০৩ কোটি ও ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে ৩২ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার কথা ছিল। অভ্যন্তরীণ খাত থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার হার গত বছরের তুলনায ২৪ দশমিক ৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও এর প্রায় পুরোটাই সঞ্চয়পত্র থেকে নেওয়া। এ সময়ে সরকার ব্যাংক খাতের ঋণ পরিশোধ করার পরেও ছয় হাজার ৭৭৭ কোটি ৮০ লাখ টাকার সঞ্চয় বাড়িয়েছে। সঞ্চয়পত্র থেকে নেওয়া ঋণের টাকা দিয়ে সরকার খাদ্য মন্ত্রণালয়কে খাদ্য আমদানি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে আগাম দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময়ে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রে সরকারের ঋণ ছিল ৪৫ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা। পরের অর্থবছর ২০০৮-০৯ এ স্বাভাবিক ঋণ প্রবৃদ্ধি থাকলেও ২০০৯-১০ অর্থবছরে হঠাৎ করেই সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে প্রবৃদ্ধি হয় ২৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ। অবশ্য এর পরের দুই অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র ক্রয়ে খুব বেশি উৎসাহ দেখা যায়নি। পাঁচ বছর পর ২০১২-১৩ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রে সরকারের ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৪ হাজার ১০৮ কোটি টাকা।
২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকেই অস্বাভাবিক বিক্রি শুরু হয় সঞ্চয়পত্র। অর্থবছরটিতে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ১৮ দশমিক ৪২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। মূলত জাতীয় নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অশান্ত হলে ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগ করতে সময় নেন। অলস টাকার পাহাড় জমা হলে আমানতের ওপর সুদ হার কমিয়ে দেয় ব্যাংকগুলো। সুদহার এক পর্যায়ে মূল্যস্ফীতিরও নিচে নেমে যায়। বেশি লাভের সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে শুরু করে সবাই। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ে ৩৭ দশমিক ৬১ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি ৩২ শতাংশ বেড়ে এ খাতে ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় এক লাখ ৩৮ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা।
পরের অর্থবছর ২০১৬-১৭ এ দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। এ সময়ে পূর্বের চেয়ে প্রায় ৪১ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। চলতি অর্থবছরের গত ১০ মাসে সরকার ৬৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকারর বেশি ঋণ নিয়েছে। মার্চের চেয়ে এপ্রিলেই ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি বিক্রি হয়েছে। ১০ মাসে সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ বাবদ ব্যয় হয়েছে ৪৩ হাজার ১০৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা। নিট বিক্রি দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার কোটি ৬৩ টাকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গত ১০ মাসে (জুলাই ২০১৭ থেকে এপ্রিল ২০১৮) সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে মোট ৪০ হাজার ৮৭০ কোটি দুই লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে। এরমধ্যে ব্যাংক খাত থেকে নিয়েছে মাত্র ৮৭০ কোটি টাকা। বাকি অর্থ নিয়েছে সঞ্চয়পত্র থেকে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে অনুন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যে সুদ পরিশোধ বাবদ রাখা হয়েছে ৪১ হাজার ৪৫৭ কোটি টাক। একক খাত হিসেবে সবচেয়ে বেশি সুদ ব্যয় হিসেবে ১৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে সঞ্চয়পত্রে।
সঞ্চয়পত্র থেকে চাহিদার অতিরিক্ত ঋণ পাওয়ায় ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ তো নিচ্ছেই না, উল্টো ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আগের বকেয়া থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করেছে বিভিন্ন ব্যাংককে। চলতি অর্থবছরেও ঋণ পরিশোধ করেছে সরকার। গত জানুয়ারি মাসে ব্যাংক ব্যবস্থায় সরকারের ঋণের স্থিতি ছিল ৯৩ হাজার কোটি টাকায়। গত এপ্রিলে তা দাঁড়িয়েছে ৬৭ হাজার কোটি টাকায়।
সরকারি ঋণের এমন চিত্র তুলে ধরে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ব্যাংকের চেয়ে সুদের হার বেশি হওয়ায় সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়েছে।
সঞ্চয়পত্র থেকে উপকারভোগী কারা হচ্ছেন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে আইএমএফ। সংস্থাটির মতে, যাদের জন্য সঞ্চয়পত্রের প্রচলন তাদের বাইরে সমাজের বিত্তশালীরাও এ সুবিধা নিচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা ২০১৩ সালে এক গবেষণা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে সংস্থাটি বলছে, সঞ্চয়পত্র কেনা মোট পরিবারের ৫৫ শতাংশের মাসিক আয় ২৮ হাজার ৭০০ টাকার উপরে। ২০১৩ সালে যেসব পরিবার সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছিল তাদের ৫৫ শতাংশের আয় ছিল প্রায় ২৯ হাজার টাকা। আয়ের মানদণ্ডে তারা সম্মানজনক অবস্থানের পরিবার।
এ বিষয়ে সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য (জ্যেষ্ঠ সচিব) ড. শামসুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, মূলত নি¤œআয়ের, প্রতিবন্ধী, পেনশনারসহ পিছিয়ে পড়া মানুষদের রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কিছুটা সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যে সঞ্চয়পত্রের বিপরিতে বেশি সুদ দেওয়া হয়। কিন্তু এখন অনেক উচ্চবিত্তও এর সুযোগ নিচ্ছে। ফলে যাদের জন্য এ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, তারা অনেকেই বঞ্চিত হচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে সঞ্চয়পত্র বিক্রির প্রক্রিয়া পুনঃবিবেচনার বিষয়ে অর্থমন্ত্রীও কথা বলেছেন।