শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক চরম অর্থনৈতিক সংকটের অন্যতম কারণ অনিয়ন্ত্রিত বৈদেশিক ঋণ ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছে শেয়ার বিজ। এতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। এ নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের আজ প্রকাশিত হচ্ছে শেষ পর্ব
ইসমাইল আলী ও মাসুম বিল্লাহ: গত অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ৬০ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সরকারের ঋণ ৫০ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার, যার মাত্র ১৫ শতাংশ চীন-রাশিয়ার। আর ৭৭ শতাংশই ছিল বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকার। বর্তমানে পাইপলাইনে বিদেশি ঋণ রয়েছে ৫০ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার। এ ঋণেরও বড় অংশই বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকার। চীন-রাশিয়ার ঋণ পাইপলাইনের মাত্র ২৫ শতাংশ।
বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উত্তরণের ফলে আগামীতে বাংলাদেশের জন্য সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। এছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশ সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের (কঠিন শর্তের ঋণ) দিকে ঝুঁকছে। এসব ঋণের সুদহার বেশি ও পরিশোধ সময়কাল কম। আর দ্বিপক্ষীয় ঋণের কারণে বিপদে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশের এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যমতে, বর্তমানে পাইপলাইনে বিদেশি ঋণ সবচেয়ে বেশি জাইকার (জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা)। সংস্থাটি আগামী কয়েক বছরে ৯৮৭ কোটি ৮৯ লাখ ডলার ঋণ দেবে বাংলাদেশকে, যা পাইপলাইনে থাকা ঋণের ১৯ দশমিক ৬২ শতাংশ। পাইপলাইনে থাকা ঋণের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পরিমাণ রাশিয়ার। এর পরিমাণ ৭৮২ কোটি ৩৩ লাখ ডলার, যা পাইপলাইনে থাকা ঋণের ১৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ। দেশটি থেকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ঋণ নেয়া হয়েছে। এটি মূলত কঠিন শর্তের ঋণ।
পাইপলাইনে থাকা সরকারের তৃতীয় সর্বোচ্চ বিদেশি ঋণ বিশ্বব্যাংকের। সংস্থাটির আইডিএ তহবিল থেকে আগামী কয়েক বছরে ৭৫৫ কোটি ২৪ লাখ ডলার ঋণ পাবে বাংলাদেশ, যা পাইপলাইনে থাকা ঋণের ১৫ শতাংশ। এছাড়া ভারতের ঋণ আটকে রয়েছে ৬৫৮ দশমিক ২৯ কোটি ডলার, যা পাইপলাইনে থাকা ঋণের ১৩ দশমিক শূন্য আট শতাংশ। দ্বিপক্ষীয় হলেও এটি সহজ শর্তের ঋণ বলেই জানান ইআরডি সংশ্লিষ্টরা।
পাইপলাইনে ঋণ আটকে থাকার দিক থেকে পঞ্চম অবস্থানে আছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। সংস্থাটি আগামী কয়েক বছরে বাংলাদেশকে ৬০৫ কোটি ৮৩ লাখ ডলার ঋণ দেবে, যা পাইপলাইনের ১২ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। এর পরের অবস্থানে রয়েছে চীন। দেশটি বিভিন্ন প্রকল্পে বাংলাদেশকে ৪৬৬ কোটি ৯৩ লাখ ডলার ঋণ দেবে, যা পাইপলাইনে থাকা ঋণের ৯ দশমিক ২৭ শতাংশ। এ ঋণ মূলত কঠিন শর্তের।
এদিকে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে কয়েক বছরে বাংলাদেশ ঋণ পেতে যাচ্ছে ১৬৩ কোটি ৫৬ লাখ ডলার, যা পাইপলাইনে থাকা ঋণের তিন দশমিক ২৫ শতাংশ। এটিও সহজ শর্তের ঋণ। এর বাইরে অন্যান্য উৎস থেকে কয়েক বছরে বাংলাদেশ ঋণ নিতে যাচ্ছে আরও ৬১৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার, যা পাইপলাইনে থাকা ঋণের ১২ দশমিক ২১ শতাংশ। এসব ঋণের প্রায় পুরোটাই সহজ শর্তের।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘নমনীয় ঋণের পাশাপাশি বাংলাদেশ বর্তমানে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের মতো কঠিন শর্তের ঋণও নিচ্ছে। কাজেই শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সাবধানতার সঙ্গে আগামী দিনে অগ্রসর হতে হবে। এক্ষেত্রে সঠিক তথ্য-উপাত্ত নির্ভর পরিকল্পনা প্রণয়ন ও দক্ষ বাজেট ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি সুশাসন নিশ্চিতে জোর দিতে হবে।’
যদিও বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক ঋণ পরিস্থিতি নিয়ে কোনো ধরনের ঝুঁকি নেই বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে সংস্থাটির গত মাসে প্রকাশিত মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এ মন্তব্য করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক ঋণের অভিঘাত (ডিসট্রেস) নি¤œ পর্যায়ে রয়েছে। একইভাবে সরকারের মোট ঋণের অভিঘাতও নি¤œ পর্যায়ে রয়েছে।
আইএমএফের তথ্যমতে, বর্তমানে জিডিপির অনুপাতে বাংলাদেশের ঋণের হার (ডেট টু জিডিপি রেশিও) ৪১ দশমিক ৪০ শতাংশ। তবে বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জিডিপির ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ গ্রহণ নিরাপদ। অর্থাৎ ডেট টু জিডিপি রেশিও’র সর্বোচ্চ নিরাপদ মাত্রা ৫৫ শতাংশ। যদিও বর্তমানে শ্রীলঙ্কার ডেট টু জিডিপি রেশিও দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১৭ শতাংশ। অর্থাৎ দেশটির মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) চেয়ে তাদের ঋণের পরিমাণ বেশি হয়ে গেছে। এতে দেশটির অর্থনৈতিক সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। এ বিষয়ে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘শ্রীলংকার অর্থনীতির কোনো বৈশিষ্ট্যই বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সুতরাং তাদের দুরবস্থার সঙ্গে আমাদের পরিস্থিতি মেলানোর কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশের তুলনায় তাদের অর্থনীতির আকার খুবই ছোট। তাদের মোট জিডিপির আকার মাত্র ৮২ বিলিয়ন ডলার। আর আমাদের জিডিপির আকার ৪১৬ বিলিয়ন ডলার। তাদের রিজার্ভের আকার মাত্র দেড় বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে আমাদের রিজার্ভ প্রায় ৪৪ বিলিয়ন ডলার। শ্রীলঙ্কার ঋণ তাদের মোট জিডিপির ১১৭ শতাংশ। অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকারের মোট ঋণ জিডিপির মাত্র ৪১ শতাংশ। তাছাড়া শ্রীলঙ্কা কঠিন শর্তের ঋণ নিয়ে বড় বড় ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ অনেক বিচার বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয়তার নিরিখে পরিকল্পিতভাবে প্রকল্প গ্রহণ করেছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেলসহ বাংলাদেশের প্রতিটি মেগা প্রকল্পই জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সরাসরি অবদান রাখবে। কিন্তু শ্রীলঙ্কা ঋণ নিয়ে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, সেগুলো তাদের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারেনি। এক্ষেত্রে দেশটি চরমভাবে অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার পরিচয় দিয়েছে। বাংলাদেশ এ ধরনের কোনো অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ নেয়নি। বাংলাদেশ ঋণগ্রহণ ও বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সবসময়ই সতর্ক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়েছে। ফলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কার মতো হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।