পাউবোর প্রধান প্রকৌশলী শহিদুলের সম্পদের পাহাড়!

নজরুল ইসলাম: সরকারি চাকরি করে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়! অবলীলায় সেসব সম্পদের কথা স্বীকারও করেছেন। তবে তার দাবি নিজের নয়, স্ত্রীর টাকায় এসব গড়েছেন। তার নাম শহিদুল ইসলাম। চাকরি করেন পানি উন্নয়ন বোর্ডে (পাউবো)। তিনি যান্ত্রিক সরঞ্জাম বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী। তার স্ত্রী আক্তিয়ারা বানু পেশায় গৃহিণী। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে এ দম্পতির সম্পদের উৎসে ব্যাপক অসঙ্গতি পাওয়া গেছে। আক্তিয়ারা বানু পেশায় গৃহিণী হলেও স্বামীর চেয়ে সম্পদের দিক থেকে এগিয়ে। সেসব সম্পদ আবার দান করে দিয়েছেন দুই কন্যাকে। অনুসন্ধানে সত্যতা পাওয়ায় তাদের দুজনের সম্পদ বিবরণী দাখিলের জন্য নোটিশ জারির অনুমোদন দিয়েছে দুদক কমিশন। এখন যেকোনো দিন নোটিশ জারি করা হবে। এর আগে গত ১ মার্চ শহিদুল ইসলামকে দুদকের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়েছে।

বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে শহিদুল ইসলামের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত বছর থেকে অনুসন্ধানে নামে দুদক। অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপসহকারী পরিচালক মনিরুল ইসলাম অবৈধ সম্পদের দীর্ঘ তালিকা পেয়েছেন বলে জানা গেছে।

সূত্র জানিয়েছে, তাদের সম্পদের মধ্যে রয়েছেÑরাজধানীর মিরপুরের পশ্চিম কাজিপাড়ায় দুই হাজার বর্গফুট আয়তনের ৭ তলা বাড়ি, মিরপুরের মনিপুরে ৬ তলা বাড়ি, দক্ষিণ মনিপুরে সোয়া ৫ শতাংশের ওপর একটি বহুতল ভবন। এছাড়া মিরপুরের সেনপাড়ায় ১৫ শতাংশ জমি ও কুষ্টিয়ায় সাড়ে ৩০০ শতাংশ জমির মালিকানা রয়েছে তাদের।

অনুসন্ধান ও আয়কর রিটার্নের তথ্যানুযায়ী, শহিদুল ইসলামের নিট সম্পদের পরিমাণ ২ কোটি ২১ লাখ ৬ হাজার ২৫৯ টাকা। তার পারিবারিক ব্যয়, ঋণ পরিশোধ ও অন্যান্যসহ মোট ব্যয় পাওয়া গেছে ১ কোটি ১৯ লাখ ৮৩ হাজার ৯২৩ টাকা। ব্যয় ও সম্পদের পরিমাণ যোগ করলে ৩ কোটি ৪০ লাখ ৯০ হাজার টাকা দাঁড়ায়। তার গ্রহণযোগ্য আয় পাওয়া যায় ২ কোটি ৬৪ লাখ ৪৯ হাজার ৬৩৮ টাকা। অর্থাৎ ৭৬ লাখ ৪০ হাজার ৫৪ টাকার সম্পদ বেশি পাওয়া গেছে। যার প্রকৃত আয়ের উৎস বৈধ নয় বলে সন্দেহ দুদকের।

আক্তিয়ারা বানুর নামে নিট সম্পদের পরিমাণ ৩ কোটি ৬ লাখ ৯৮ হাজার টাকা পাওয়া গেছে। পারিবারিক ব্যয়, ঋণ পরিশোধ ও অন্যান্য ব্যয় পাওয়া যায় ৪ কোটি ৫২ লাখ ৮৫ হাজার ২৪১ টাকা। সব মিলিয়ে মোট ৭ কোটি ৫৯ লাখ ৮৪ হাজার টাকার সম্পদ ও অর্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। অথচ দুদকের অনুসন্ধানে গ্রহণযোগ্য আয় পাওয়া যায় ৫ কোটি ৫৬ লাখ ৬৭ হাজার টাকার। এখানে সন্দেহজনক আয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৩ লাখ ১৬ হাজার টাকার বেশি।

প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম ও তার স্ত্রী দুজনেই খুলনার ভেড়ামারা সার্কেলে আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন। প্রকৌশলী শহিদুল ইসলামের ২০১৯-২০ সালের আয়কর নথি অনুযায়ী বছরে তার মোট আয়ের পরিমাণ ১৭ লাখ ৫৯ লাখ ৮২৮ টাকা। এর মধ্যে গৃহসম্পত্তি থেকে আয় দেখিয়েছেন ৮ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। যার বিপরীতে তিনি কর দিয়েছেন ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৭ টাকা। সম্পদের বর্ণনায় মিরপুরে সাত তলা বাড়ি অর্ধেকাংশ, মিরপুরে সেনপাড়ায় তিনভাগে প্রায় ২০ শতাংশ জমিসহ টিনশেড বাড়ি ও কুষ্টিয়ায় কৃষিজমিসহ মোট ৭৭ লাখ ৩৫ হাজার ৯৬৫ টাকা মূল্যের সম্পদ। এছাড়া স্ত্রীর কাছে লোন ও ব্যাংক ঋণের কথা উল্লেখ করেছেন আয়কর রিটার্নে।

অন্যদিকে তার স্ত্রীর ২০১৯-২০ সালের আয়কর বিবরণী অনুসারে গৃহ-সম্পত্তি, কৃষি ও ব্যবসা থেকে আয় দেখিয়েছেন বছরে সাড়ে ১৫ লাখ টাকা। যার বিপরীতে প্রদেয় কর ১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন তিনি। সম্পদের মধ্যে রয়েছে মিরপুরর কাজিপাড়ায় ৪ কাঠা জমিসহ ৬ তলা ভবন, মিরপুরে সাত তলা বাড়ি অর্ধেকাংশ, ১০ বিঘা কৃষি জমি ও ৮০ ভরি স্বর্ণালংকারসহ মোট ৭৭ লাখ ৩৫ হাজার টাকার সম্পদের বর্ণনা দিয়েছে আয়কর রিটার্নে।

দুদক ও এনবিআর সূত্রে দেখা গেছে, প্রকৌশলী শহিদুল ও তার স্ত্রীর যৌথ মালিকানায় মিরপুরের দক্ষিণ মনিপুরে সোয়া পাঁচ শতাংশ জমি ও বহুতল ভবন এবং মিরপুর ৫৩৫/১ এ যৌথ নামে ৭ তলা বাড়ি (প্রতি তলা ১৯৫০ বর্গফুট) রয়েছে। যদিও সম্পদের দায় এড়াতে ২০২০ সালে তা কন্যাদের নামে দান করে দিয়েছেন তারা। অন্যদিকে প্রকৌশলী শহিদুলের নামে মিরপুরের সেনপাড়ায় ১৫ শতাংশ জমির মালিকানা রয়েছে। যা তিনি ২০০৭ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ক্রয়সূত্রে মালিক হয়েছেন।

এছাড়া স্ত্রী আক্তিয়ারা বানুর নামে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের মিরপুরের পশ্চিম কাজীপাড়ার সেনপাড়ায় ৬ তলা ভবনসহ ৬.৬০ জমি (বাড়ি নং ৮২৭/২/৫) ছিল। যার প্রতিটি ফ্লোর আড়াই হাজার বর্গফুটের। ওই ভবনও ২০১৯ সালে তাদের দুই মেয়েকে দান করেন। প্রকৃতপক্ষে শহিদুল ইসলাম ও তার স্ত্রী আক্তিয়ারা বানুর অর্জিত সম্পদ মেয়েদের নামে দান করেছেন। এছাড়া আক্তিয়ারা বানুর নামে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় ক্রয় সূত্রে প্রায় সাড়ে ৩০০ শতাংশ জমি মালিকানার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে অনুসন্ধানে।

অনুসন্ধান পর্যায়ে দেশের ৫৭টি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, রাজউক, দুই সিটি করপোরেশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, ভূমি অফিস ও সাব-রেজিস্ট্রার অফিসসহ শতাধিক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শহিদুল ইসলাম, তার স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে থাকা নথিপত্র তলব করেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা।

দুদক সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি করার সুবাদে বিভিন্ন দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শহিদুল ইসলামের ৭৬ লাখ ৪০ হাজার টাকার উৎসবহির্ভূত সম্পদের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। ২ কোটি টাকার বেশি সন্দেহজনক স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য রয়েছে। আক্তিয়ারা বানুর পৈতৃক সম্পত্তি এবং পিতার কোম্পানি থেকে প্রাপ্ত অর্থ, গৃহসম্পত্তির ও জমি বিক্রয় থেকে আয় এবং বিভিন্ন ব্যাংক থেকে গৃহীত ঋণ ছাড়া তার নিজস্ব কোনো আয়ের উৎস নেই।

অভিযোগের বিষয়ে শহিদুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, এসব সম্পদ রয়েছে, সত্য। এগুলো আমার স্ত্রীর আয়ের টাকায় কেনা। তিনি ব্যবসা করেন। আমাদের তামাকের ব্যবসা। আমার শ্বশুর অনেক বড় ব্যবসায়ী। ধনী লোক। উনাকে এক নামে সবাই চেনে। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় আমাদের ‘মনমোহন’ নামের বিড়ির ব্যবসা রয়েছে। এটা আমাদের জন্মগত ব্যবসা। দুদক সম্পদ বিবরণী দাখিলের চিঠি দিলে, আমরা কাগজপত্র জমা দেবো।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০