এসএস পাওয়ার লিমিটেড

পাওনা আদায়ের বিক্ষোভে পাঁচ শ্রমিক নিহত

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার গণ্ডামারা ইউনিয়নের পশ্চিম বড়ঘোনায় এস আলম গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসএস পাওয়ার প্লান্টের নির্মাণাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হয়েছেন। গতকাল সকালে বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বকেয়া বেতন-ভাতাসহ ১০ দফা দাবি-সংক্রান্ত বিক্ষোভ থেকে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেনÑআহমদ রেজা (১৮), রনি হোসেন (২২), শুভ (২৪), মো. রাহাত (২৪) এবং রায়হান (২৫)।

প্রকল্প এলাকার লোকজন বলেন, দেশি শিল্পগ্রুপ এস আলম এবং চীনা বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের যৌথ মালিকানাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কর্মরত শ্রমিকরা চলমান রমজানে ইফতারের এক ঘণ্টা আগে ছুটি, শুক্রবারের অর্ধবেলা ছুটি, খেয়াল খুশিমতো শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ, কর্মপরিবেশ উন্নত, বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধসহ ১০ দফা দাবি আদায়ে কয়েকদিন ধরে আন্দোলন করছিলেন। একইভাবে শনিবার সকালের শ্রমিকরা বিক্ষোভ করে। এ সময়ে পুলিশ ও শ্রমিকের মধ্যে উত্তোজনা দেখা দেয়, যা এক পর্যায়ে সংর্ঘষে রূপ নেয়। আর এ ঘটনায় পাঁচজন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে চারটি মরদেহ বাঁশখালী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রাখা হয়। আর রায়হান নামের একজনের মৃত্যু হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এছাড়া প্রাথমিক অবস্থায় আরও ৩০ জন হয়েছেন। আহতদের স্থানীয় ও চট্টগ্রাম মহানগরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।

উত্তেজিত শ্রমিকরা এরপর পাওয়ার প্লান্টের স্থাপনা ও পুলিশের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন, যা দুপুর ১টা পর্যন্ত আগুন নিয়ন্ত্রণে আসেনি। আর ঘটনার পরপর শ্রমিকদের ভয়ে প্লান্ট ছেড়ে চলে যেতে দেখা যায়। অপরদিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আলাউদ্দিন তালুকদার বলেন, বাঁশখালীর বিদ্যুৎকেন্দ্র পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের সংঘর্ষেও ঘটনায় দুজন পুলিশসহ মোট ২০ জনকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছে। তাদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে ২টার দিকে একজন মারা যান। তার নাম রায়হান, বয়স ২৫।

জানা যায়, ২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এক হাজার ২২৪ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য এসএস পাওয়ার লিমিটেড ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের মধ্যে চুক্তি হওয়ার পর স্থানীয় লোকজনের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে পরিবেশ বিপর্যয় ও বসতভিটা হারানোর শঙ্কা থেকে স্থানীয় বাসিন্দারা এ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন। একই বছরের চার এপ্রিল এ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনকে কেন্দ্র স্থানীয় জনগণ ও মালিকপক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি অবস্থান ও সমাবেশ ডাকা নিয়ে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে ছিল। ওই সংঘর্ষে চারজন নিহত হয়েছিল। এ ঘটনায় পুলিশসহ কমপক্ষে ১৯ জন আহত হয়েছিলেন।

গতকাল বিকাল ৫টায় বাঁশখালী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সাইদুজ্জামান চৌধুরী শেয়ার বিজকে বলেন, বেতন ভাতার দাবিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রে সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হওয়ার খবর পেয়েছি। এ সময় বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে। পাওয়ার প্লান্টের কিছু গাড়ি ও স্থাপনায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলেন শ্রমিকরা। পরে স্থানীয় প্রশাসন, জেলা পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাসহ আমরা এস আলম গ্রুপ ও চীনা কোম্পানি প্রতিনিধিসহ সবাই মিলে মিটিং করেছি। মিটিং সিদ্ধান্ত হয়েছে নিহত প্রত্যক শ্রমিকের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে তিন লাখ টাকা আর আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে দেবে এস আলম গ্রুপ। পাশাপাশি শ্রমিকদের সব দাবি মেনে নেবেন বলের আশ্বাস দিয়েছে এস আলম গ্রুপ ও চীনা সেপকো গ্রুপ, যা আমাদের লিখিত আকারে দেবে। এছাড়া এ ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রিটকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা আগামী চার কর্মদিবসের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবেন। প্রাথমিক অবস্থায় মনে হচ্ছে শ্রমিকদের মাঝে নানা বিষয়ে নিয়ে অসন্তোষ ছিল। পাশাপাশি বাইরের কোনো পক্ষ থেকেও ইন্ধন ছিল।  

সূত্রে জানা যায়, এসএস পাওয়ার লিমিটেডের বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে মোট ৭০ শতাংশ ইকুইটি বিনিয়োগ করেছে দেশের অন্যতম শীর্ষ শিল্পগ্রুপ এস আলম। এ গ্রুপের ছয়টি সহযোগী কোম্পানির ৭০ শতাংশের মালিক। আর বাকি ৩০ শতাংশ চীনার সেপকো থ্রি ইলেকট্রিক পাওয়ার কনস্টাকশন কোম্পানি এবং এইচটিজি ডেভেলপমেন্ট গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি গত এপ্রিল ২০২০ সালের বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসার কথা থাকলেও এখনও পর্যন্ত উৎপাদনে আসতে পারেনি। প্রকল্পটিতে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ধরা হয়েছিল ২৪৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় প্রায় ২১ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। আর প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে বাংলাদেশ, চীনা, ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশের প্রকৌশলীরা। পাশাপাশি কয়েক হাজার বাংলাদেশি শ্রমিকও কাজ করছে। বর্তমানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণকাজ ৪০ শতাংশ শেষ হয়েছে।

এ বিষয়ে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল আলম মাসুদ দেশের বাহিরে থাকায় মন্তব্য নেয়া যায়নি। পরে গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুস সালাস লাবুর মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও ফোন রিসিভ করেননি। ফলে তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি। পরে অন্য দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারাও মন্তব্য করতে রাজি হননি।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের বহুমাত্রিক শিল্প গ্রুপ। এ গ্রুপের পরিবহন, হোটেল, ঢেউটিন, সয়াবিন তেল, সিমেন্ট, চিনি, সিআর কয়েল, পোশাক খাতসহ বেশ কয়েকটি শিল্প খাতে একাধিক কারখানা আছে। যদিও শুরুতে এস আলম গ্রুপ কয়েক বছরে আগেও তেল, গম, চিনি আমদানিতে শীর্ষে অবস্থানে থাকলেও বর্তমানে ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা থেকে কিছুটা সরে এসে জ্বালানি, সিমেন্ট, ইস্পাত, পোশাক, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০