Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 8:52 pm

পাঙ্গাশ মাছের চাষ

মানবদেহের জন্য উপকারী উচ্চমানের প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ রয়েছে পাঙ্গাশে। কৃষি-কৃষ্টির আজকের আয়োজন মাছটির নানা দিক নিয়ে

আমিষের চমৎকার উৎস পাঙ্গাশ। মাছটি প্রাকৃতিক মুক্ত জলাশয় বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের নদীসহ উপকূলীয় অঞ্চলে পাওয়া যায়। বর্তমানে পরিবেশগত পরিবর্তনের ফলে নদীর নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে। একই সঙ্গে প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় উৎপাদন কমে যাচ্ছে। তবে পুকুরে পাঙ্গাশ চাষের সম্ভাবনা থাকায় আশির দশক থেকে এর উৎপাদন ব্যাহত হয়নি। বরং পুকুরে পাঙ্গাশ চাষের কার্যক্রম অতীতের তুলনায় বেড়েছে। এ মাছ চাষ পদ্ধতি নির্ভর করে পুকুর বা জলাশয়ের বৈশিষ্ট্য, পরিবেশগত অবস্থা, পানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা, মানসম্মত পোনা প্রাপ্তি, বাজার ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি বিষয়ের ওপর।

জাত
দেশি পাঙ্গাশ দেশি পাঙ্গাশের রুপালি রঙের পিঠের দিকটি কালচে ও পার্শ্বরেখার ওপর সামান্য ধূসর। এ মাছে কোনো আঁশ নেই। দেশীয় পাঙ্গাশ সুস্বাদু। পদ্মা, মেঘনা, বহ্মপুত্র, যমুনা প্রভৃতি নদ-নদীতে এ মাছটি বেশি পাওয়া যায়। এরা প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে। মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন নদ-নদীতে এর পোনা পাওয়া যায়।
থাই পাঙ্গাশÑ এদের আদিবাস থাইল্যান্ডে, ভিয়েতনাম ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোয়। দেশে ১৯৯৩ সালে বিদেশি এ প্রজাতির মাছের সফল প্রজনন করানো হয়। বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের ক্ষেত্রে থাই পাঙ্গাশ একটি জনপ্রিয় নাম। দেশি পাঙ্গাশের চেয়ে এ জাত দ্রুত বৃদ্ধি পায়। মাছটির ওজন ১০ থেকে ১২ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।

চাষ পদ্ধতি
পুকুর নির্বাচন
পাঙ্গাশ চাষের পুকুর আয়তাকার হলে ভালো। পুকুরের তলা ভালোভাবে সমতল করে নিতে হবে। পানির গভীরতা এক দশমিক পাঁচ থেকে দুই মিটার পর্যন্ত রাখতে হবে। দোআঁশ মাটির পুকুর সবেচেয়ে ভালো। প্রয়োজনে যেন দ্রুত পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা যায় সেজন্য পুকুরের কাছে গভীর বা অগভীর নলকূপের ব্যবস্থা রাখতে হবে। বর্ষা বা অতিরিক্ত বৃষ্টিতে পুকুরের পাড় যেন ভেঙে না যায় সে জন্য আগে থেকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। যোগাযোগ সুবিধা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো পুকুর নির্বাচনের জন্য এমন জায়গা বেছে নিতে হবে।

পুকুর প্রস্তুতি

পুকুর নির্বাচনের পর মাছ চাষের উপযোগী করে তুলতে হবে একে। পুকুরে নানা প্রকৃতির জলজ আগাছা থাকে। প্রথমে এগুলোকে সরিয়ে ফেলতে হবে। অপ্রয়োজনীয় ও রাক্ষুসে মাছ বিশেষ করে শোল, বোয়াল, গজার, টাকি প্রভৃতি চাষের আগে অপসারণ করতে হবে। অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় ও রাক্ষুসে মাছদের সম্পূর্ণ ধ্বংস করা সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে স্থানীয় মৎস্য অফিসের পরামর্শ অনুযায়ী বিভিন্ন ওষুধ ব্যবহার করে দমন করা যেতে পারে।

পুকুরে মাছ চাষের উপযুক্ত ও টেকসই করতে চুন দেওয়া যেতে পারে। যেসব পুকুরের পানিতে অম্লত্বের সমস্যা নেই সেখানে প্রতি হেক্টরের জন্য ২৫০ থেকে ৩০০ কেজি চুন দিতে হয়। চুন দেওয়ার আগে ভালো করে মিহি করে নিলে এর কার্যকারিতা অনেকগুণ বেড়ে যায়।

পুকুরের প্রাকৃতিক খাবার উৎপাদন বাড়ানোর জন্য জৈব ও রাসায়নিক সার দুটোই ব্যবহার করা হয়। সাধারণত চুন দেওয়ার চার থেকে পাঁচ দিন পর সার দিতে হয়। নতুন পুকুর ও বেলে মাটির পুকুরে জৈব সার তুলনামূলক বেশি দিতে হয়। তবে পুরাতন কাদাযুক্ত পুকুরে রাসায়নিক সারের মাত্রা একটু বেশি হবে। প্রতি শতকে আট থেকে ১০ কেজি গোবর অথবা চার থেকে পাঁচ কেজি মুরগির বিষ্ঠা ব্যবহার করতে হবে। সারের কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য প্রতি শতকে ১০০ গ্রাম টিএসপি জৈব সারের সঙ্গে আট থেকে ১০ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে ব্যবহার করা ভালো। সার দেওয়ার চার থেকে পাঁচ দিন পরে পুকুরের পানির রঙ সবুজ বা বাদামি হলে সাধারণত পোনা মজুদের উপযোগী হয়।

একক বা নিবিড় চাষ পদ্ধতি

এ পদ্ধতিতে কম সময়ে বেশি উৎপাদনের উদ্দেশে বেশি ঘনত্বে পোনা মজুদ করা হয়। এক্ষেত্রে আমিষ সমৃদ্ধ কৃত্রিম খাবারের মাধ্যমে বেশি মুনাফা করা যায়। উন্নত চাষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে হেক্টর প্রতি ১৫ থেকে ২০ টন উৎপাদন সম্ভব। একক চাষে প্রতি হেক্টরে আট থেকে ১০ সেন্টিমিটারের ২০,০০০ থেকে ২৫,০০০টি পোনা মজুদ করা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে বিগত বছরের পোনা মজুদ করে অধিক উৎপাদন ও বেশি মুনাফা লাভ করা সম্ভব।

পোনা সংগ্রহ ও পরিবহন

পুকুরের প্রস্তুতি শেষে ভালো মানের হ্যাচারি থেকে উন্নত মাছের পোনা সংগ্রহ করতে হবে। পোনা পরিবহনের সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যাতে পোনার কোনো ক্ষতি না হয়। পরিবহনের আগে চৌবাচ্চায় চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা পোনা রাখতে হবে। পরিবহনের সময় বেশি নড়াচাড়া করা উচিত নয়।

খাদ্য

পুকুরে যে প্রাকৃতিক খাবার তৈরি হয় তা মাছের আশানুরূপ বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট নয়। তাই সুষম খাদ্য অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, দৈনিক নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্য সরবরাহ না করতে পারলে পাঙ্গাশের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়। মাছের খাদ্যের পরিমাণ মাছের বয়স ও ওজনের ওপর নির্ভর করে। ১৫ দিন পরপর নমুনা হিসেবে কয়েকটি মাছের ওজন পরীক্ষা করে দেখতে হবে, মাছ ঠিক মতো বাড়ছে কি না। নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্য পুকুরের আয়তন অনুযায়ী নির্ধারিত ছয় থেকে আটটি স্থানে দেওয়া ভালো। দানাদার জাতীয় খাবার ও সম্পূরক খাবার বল আকারে নির্দিষ্ট জায়গায় সরবরাহ করতে হবে। খাবার একবারে না দিয়ে দুই থেকে তিন বারে সমানভাবে ভাগ করে দিলে খাদ্যের কার্যকারিতা অনেক বেড়ে যায়।

পরিচর্যা

পানি ভালো রাখার জন্য অবস্থা বুঝে আংশিক পরিবর্তন করতে হবে। ১৫ দিন অন্তর শতকে ২৫০ গ্রামে হারে চুন ও খাদ্য লবণ একত্রে দিতে হবে। তবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য কোনোভাবে দেওয়া যাবে না। অক্সিজেনের অভাব হলে পুকুরে পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পানি বেশি সবুজ হলে পুকুরে খাদ্য কম দিতে হবে। বেশি ঘনত্বে মাছ থাকলে খাবার দেওয়ার পরে মাছ পানির উপরের স্তরে চলে আসে। এ কারণে শিকারি পাখি মাছ ধরে নিতে পারে। এজন্য পুকুরের ওপর নেট দেওয়া যেতে পারে।

মাছ সংগ্রহ

বাজারের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে মাছ মজুদের পাঁচ থেকে ছয় মাস পর যখন পাঙ্গাশের গড় ওজন ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম হয়, তখনই মজুদকৃত মাছের ৫০ শতাংশ বাজারে বিক্রি করে দিতে হয়। এতে করে অবশিষ্ট মাছ দ্রুত বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়।

মিশ্র চাষ

বাণিজ্যিকভাবে থাই পাঙ্গাশের সঙ্গে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ লাভজনকভাবে চাষ করা যায়। সুষম দানাদার খাবার দিয়ে এক বছরের পাঙ্গাশের সঙ্গে তেলাপিয়া, কৈ, গলদা চিংড়ি, শিং, মাগুর প্রভৃতি চাষ করা যায়।

পুষ্টিগুণে ভিন্ন ও অনন্য

অন্যান্য মাছের মতো পাঙ্গাশে উচ্চমানের প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ রয়েছে। এসব উপাদান মানবদেহের জন্য উপকারী।

পাঙ্গাশে অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো এসিড (বা ইনডিসপেন্সেবল অ্যামাইনো এসিড) তুলনামূলক বেশি

এই অ্যামাইনো এসিড কোষের দেয়াল তৈরি, দেহের বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে

পাঙ্গাশে থাকা আমিষের মান উন্নত। মাছটির ৬০ শতাংশ ক্যালোরি আসে আমিষ থেকে

ওমেগা৩-এর চমৎকার উৎস এই মাছ

স্বল্প পরিমাণে স্যাচুরেটেড ফ্যাট রয়েছে এতে। এ উপাদানটি কার্ডিভাসকুলার ডিজিজের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক

কার্বোহাইড্রেট নেই

কোলেস্টেরলের মাত্রা তুলনামূলক কম

সোডিয়ামের উপস্থিতি নেই পাঙ্গাশে।

সতর্কতা

পাঙ্গাশে চর্বি বেশি। তাই অতিরিক্ত আহার থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে মাংসের চেয়ে এতে চর্বির উপস্থিতি কম।

 

পাঙ্গাশের আচার …
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকোয়াকালচার বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবদুস সালাম পাঙ্গাশের হরেক রকমের আচার তৈরি করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। তার তৈরি আচার নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খরব প্রকাশ হয়েছে। এরই কিছু চৌম্বক অংশ তুলে ধরা হলো:

উপকরণ

কাটা ছাড়া পাঙ্গাশের ছোট টুকরো এক কেজি

পাঁচ থেকে ছয় চা চামচ শুকনো মরিচের গুঁড়ো

দুই চা চামচ হলুদ গুঁড়ো

সরষের তেল ৪০০ মিলিলিটার

দুই চা চামচ সরষে

দুই চা চামচ মেথি

দুই থেকে দুই দশমিক পাঁচ কাপ পেঁয়াজ কুচি

চার চা চামচ আদা বাটা ও এক থেকে দুই কাপ আদা কুচি

চার চা চামচ রসুন বাটা ও এক থেকে দুই কাপ রসুন কুচি

চার থেকে পাঁচটি কাঁচামরিচ ফালি

এক থেকে দেড় কাপ ভিনেগার।

পদ্ধতি

প্রথমেই মাছের কাঁটা ফেলে এক সেন্টিমিটার আকারের ছোট ছোট টুকরো করতে হবে। কাটা মাছ ধুয়ে পানি ঝরিয়ে এক কেজি মাছের মধ্যে এক চামচ হলুদ গুঁড়ো, দুই চামচ মরিচ গুঁড়ো, পরিমাণমতো লবণ মিশিয়ে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। এরপর মাছগুলোকে কড়াইয়ে অল্প সরষের তেলে ভাজতে হবে। খুব কড়া করে ভাজার প্রয়োজন নেই। কড়াইয়ে দুই কাপ পরিমাণ সরষের তেল নিয়ে গরম করে দুই চা চামচ সরষে দিয়ে না ফোটা পর্যন্ত নাড়াতে হবে।
দুই চা চামচ মেথি দিয়ে নাড়ার পর পেঁয়াজ কুচি ভেজে লাল করতে হবে। এবার চার থেকে পাঁচ চা চামচ করে আদা বাটা, রসুন বাটা ও চার চা চামচ শুকনো মরিচ বাটাসহ চার থেকে পাঁচটি কাঁচামরিচ ফালি দিয়ে কড়া করে ভাজতে হবে। মসলা ভাজার শেষ পর্যায়ে আধা কাপ করে আদা ও রসুন কুচি দিয়ে কিছুক্ষণ ভাজতে হবে। মসলা গুঁড়ো কড়া হলে ভাজা মাছগুলো তাতে ঢেলে দিয়ে ১৫ থেকে ২০ মিনিট অল্প আচে নাড়তে হবে। প্রয়োজনে আরও তেল দিতে হবে যেন মাছের টুকরোগুলো তেলের নিচে ডুবে থাকে। এবার চুলা বন্ধ করে লবণ চেখে নামাতে হবে।
এক থেকে দেড় কাপ ভিনেগার দিয়ে নেড়ে রেখে দিতে হবে। ঠাণ্ডা হলে কাঁচের পাত্রে ভরে রাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন পাত্রের ভেতর মাছ ভরার পর মাছের ওপর তেল ভাসে।

 

কৃষি-কৃষ্টি ডেস্ক