নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশ থেকে বিভিন্ন উপায়ে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ বাজেটে বৈধ করার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। কর দিয়ে এসব অর্থ বৈধ হয়ে গেলে এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে না আয়কর কর্তৃপক্ষসহ যেকোনো কর্তৃপক্ষ। গতকাল বৃহস্পতিবার ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় তিনি এই প্রস্তাব দিয়েছেন। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ও চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। এ অবস্থায় আগামী অর্থবছরে আমাদের কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হতে পারে।
এ অবস্থায় আর্থিক নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অধিক বিচক্ষণতা ও দূরদর্শী পন্থা অবলম্বন করতে হবে। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সরকারি ব্যয় নির্বাহের জন্য একদিকে আমাদের অধিক পরিমাণে রাজস্ব জোগান দিতে হবে, অন্যদিকে বেসরকারি খাতেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আনতে হবে। এ অবস্থায় বিদেশে অর্জিত অর্থ ও সম্পদ অর্থনীতির মূল স্রোতে আনার মাধ্যমে বিনিয়োগ ও আর্থিক প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে তিনি আয়কর অধ্যাদেশে নতুন বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব দেন।
নতুন বিধানের বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রস্তাবিত বিধান অনুযায়ী বিদেশে অবস্থিত যে কোনো সম্পদের ওপর কর পরিশোধ করা হলে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ কোনো কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করবে না। বিদেশে অর্জিত স্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে আনা না হলে এর ওপর ১৫ শতাংশ, বিদেশে থাকা অস্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে আনা না হলে ১০ শতাংশ ও বাংলাদেশে পাঠানো (রেমিটকৃত) নগদ অর্থের ওপর সাত শতাংশ হারে করারোপের প্রস্তাব করেন তিনি। এ সুবিধা ২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
বাজেটে কৃচ্ছ্র সাধনে উদাসীনতা
বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও ডলারের সংকট মোকাবিলা। এ দুই পাখি যদি এক ঢিলে মারতে হয়, তাহলে সরকারকে ব্যয়ের ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্র সাধনের উদ্যোগ নেয়ার দরকার ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে সরকারের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। বিশেষ করে বিদেশ ভ্রমণ, বৈদেশিক প্রশিক্ষণ ও গাড়ি ক্রয়ের মতো বিষয় নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি যেসব উন্নয়ন প্রকল্পে বিপুল পরিমাণ আমদানির প্রয়োজন পড়ে, সেগুলোয় ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নেয়া দরকার ছিল। কিন্তু বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব দেয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ উল্লেখ করা হয়নি।
এছাড়া বাজেটে বেশকিছু চমক আছে। যেমন রপ্তানি খাতে তৈরি পোশাক ও তৈরি পোশাক বহিভর্‚ত খাতে করপোরেট করে যে ব্যবধান ছিল, সেটি বিলোপ করা হয়েছে। সার্বিকভাবে করপোরেট করহার আড়াই শতাংশ কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া সারে ভর্তুকি বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে, যাতে এগুলোর দাম বাড়াতে না হয়। কৃষি ও প্রাথমিক শিক্ষায় বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ানো হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে বেশ উদারতা দেখানো হয়েছে। তবে একটি ক্ষেত্রে ভুল উদারতা দেখানো হয়েছে। তা হলো বিদেশে অর্জিত সম্পদ নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ হস্তান্তর করে সম্পদ বৈধকরণ। এতে খুব বেশি লাভ হবে বলে মনে হয় না। তবে এতে করে এক ধরনের ভুল বার্তা সমাজের কাছে যায়। তা হলো অর্থ চুরি করে বিদেশে পাচার করার পর সহজেই তা বৈধ করা যাবে। সুতরাং এটি যুক্তসঙ্গত নয়।
পুঁজিবাজারের জন্য নতুন কিছুই নেই
সার্বিক বাজেটে নতুন কোনো চমক নেই। অতীতের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে বাজেট পেশ করা হয়ছে। আমার মতে, পুঁজিবাজার সম্পর্কে নতুন কিছুই নেই। কিছু কোম্পানির ক্ষেত্রে আড়াই শতাংশ কর কমানোর কথা বলা হয়েছে। নন-লিস্টেড কোম্পানির ক্ষেত্রেও একই সুবিধা দেয়া হয়েছে। সুতরাং পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য বিশেষ কিছু রাখা হয়নি বাজেটে। পুঁজিবাজার নিয়ে অনেক পরামর্শ ছিল। কিন্তু কিছুই গ্রহণ করেনি সরকার। গত বছরের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার একটা বিশেষ সুযোগ ছিল সেটা এবার উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে পাচার করা টাকা দেশে নিয়ে আসার জন্য আরও বড় পথ খুলে দেয়া হয়েছে। সেটা হচ্ছে যে, যারা বিদেশ থেকে অর্থ ফেরত আনতে চাই তাদের অর্থের উৎসের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করা হবে না। রেমিট্যান্স আকারে আসবে। আর রেমিট্যান্সতো ট্যাক্স ফ্রি। সুতরাং যারা টাকার পাচার করেছে তাদের পুরস্কৃত করা হলো আরকি।
৫ দশমিক ৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতির কথা বলা হচ্ছে। এটা কীভাবে সম্ভব? এরই মধ্যে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে চলে গেছে। এই বাজেট কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, তা আমার জানা নেই। তবুও অর্থনীতিটা ভালো চলুক, এটাই আমার প্রত্যাশা।
বাংলাদেশ করপোরেট ট্যাক্স ধাপে ধাপে কমাচ্ছে। এটা সারা পৃথিবীতে আগেই কমেছে। কিন্তু পুঁজিবাজারের জন্য যে কিছু করা দরকার, সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। অথচ বিভিন্ন সময়ে সরকার থেকে বলা হয়, পুঁজিবাজার ভালো করার ক্ষেত্রে তারা পদক্ষেপ নিচ্ছেন। কিন্তু বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য নতুন কিছুই রাখা হয়নি।
অন্তত এক লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশের ওপর কর মওকুফ করা যেত; এক সময় ছিল এটা। কিন্তু এখন ৫০ হাজার টাকার বেশি হলে কর দিতে হয়। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে আরও ছাড় দেয়া উচিত। কারণ তাদের ছাড় না দিলে কেন তারা রেগুলেটরি বডির অধীনে আসবে। এখানে আসলে তো আয় গোপন করা যাবে না। তালিকার বাইরে থাকলে তো মোটেও কর দেয় না। তাই পুঁজিবাজারের জন্য আরও অনেক কিছু করার ছিল।
বাজেট বাস্তবায়নের নির্দিষ্ট রূপরেখা নেই
আমি যেটা দেখলাম, অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় অনেক বক্তব্য রেখেছেন। কোন কোন খাতে কত টাকা ব্যয় হয়েছে ও খাতভিত্তিক অর্জনের কথা বলেছেন। কিন্তু কী করবেন, সে বিষয়ে কোনো পরিষ্কার বক্তব্য ছিল না। বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার কোনো রূপরেখা নেই। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ঘাটতি পূরণ, আয় বৈষম্য হ্রাসকরণ, দেশীয় শিল্পের বিকাশ ও রপ্তানি বহুমুখীকরণের বিষয়ে কোনো বক্তব্য ছিল না। শুধু বলা হয়েছে প্রণোদনা দেয়া হবে। বিভিন্ন খাতের বরাদ্দ বৃদ্ধির একটি গাণিতিক হিসাব উপস্থাপন করা হয়েছে।
ব্যাংক থেকে আগামী অর্থবছরে এক লাখ ছয় হাজার কোটি টাকার ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আমি মনে করি এটা ঠিক হয়নি। এমনিতেই ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে আছে। তাই, এ বিষয়টি আমি সমর্থন করি না। ব্যাংগুলো সবসময় নিরাপদ বিনিয়োগের জায়গা খোঁজে। সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ তুলনামূলক বেশি আগ্রহ প্রকাশ করে ব্যাংকগুলো। কারণ এটা ঋণের চেয়ে বেশি নিরাপদ। ব্যাংক থেকে ঋণ বেশি নিলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমার মতে ব্যাংক থেকে সরকারি ঋণ কমানো উচিত।
বাস্তবায়নযোগ্য কি না সেটা নিয়ে প্রশ্ন
সার্বিক বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য কি না সেটা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। কারণ ক্যাপিটাল মার্কেট সম্পর্কে বিশেষ কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। সরকার যদি ব্যাংক থেকে বেশি বেশি ঋণ নেয়, তাহলে বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যেতে পারে। তাই আমি মনে করি, ব্যাংক থেকে সরকারি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি না করাই ভালো ছিল। এমনিতেই বেসরকারি ঋণের যে প্রবৃদ্ধি আছে, তা মুদ্রানীতিতে ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম। ফলে যদি সরকারি ঋণ বৃদ্ধি পায় তাহলে বেসরকারি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কাজেই বাজেটে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা কমানো উচিত ছিল। এতে বেসরকারি খাতে আরও বেশি বিনিয়োগ হওয়ার সুযোগ তৈরি হতো।