নিজস্ব প্রতিবেদক: বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ সাত শতাংশ, ১০ শতাংশ, অথবা ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করার যে সুযোগ নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে দেয়া হয়েছে, তা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না বলে মনে করছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংগঠনটি বলছে, পাচার হওয়া অর্থ দেশে আনার সুযোগ নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয় এবং এ উদ্যোগ সৎ করদাতাদের জন্য চপেটাঘাত। সংস্থাটি বলছে, প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতির চাপ সহনীয় রাখার জন্য যে উদ্যোগ ও উদ্যম আছে, তার চেয়ে বেশি বেশি সুযোগ দেয়া হচ্ছে যারা আইনকানুন ভঙ্গ করে অবৈধভাবে টাকা নিয়ে গেছেন, তাদের।
রাজধানীর একটি হোটেলে গতকাল ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট পর্যালোচনা উত্থাপনকালে এক প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। সংবাদ সšে§লনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান প্রমুখ।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেন। বাজেটের বিশাল ব্যয় মেটানোর জন্য অর্থ সংগ্রহে অর্থমন্ত্রী নতুন একটি পথ খুঁজে বের করেছেন। বিদেশ থাকা সম্পদের ‘দায়মুক্তি’ দিয়ে তিনি তা দেশে আনার ঘোষণা দিয়েছেন। এর ফলে ১৫ থেকে সাত শতাংশ কর দিয়ে বিদেশে থাকা স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি দেশে বৈধ আয়ের তালিকায় যুক্ত করা যাবে, সেই অর্থ দেশেও আনা যাবে। ওই আয়ের উৎস জানতে চাওয়া হবে না।
তবে অর্থমন্ত্রীর এই নতুন কৌশলকে একই সঙ্গে নৈতিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে এবং রাজনৈতিকভাবেও গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করেন মোস্তাফিজুর রহমান। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘অনেকে দেশে অবৈধ উপায়ে টাকা আয় করে সেটা বিদেশে নিয়ে গেছেন। বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে টাকা বাইরে নিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সিপিডি সব সময় এই ধরনের পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছে, এখন আরও জোরালোভাবে বিরোধিতা করার সময় এসেছে।’ এছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটে সৃজনশীলতা ও সংবেদনশীলতার ঘাটতি রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এ বিষয়ে তিনি বলেন, সরকারের অনেকগুলো ভালো ভালো আইন ও নীতি রয়েছে। কিন্তু সেগুলো পরিপালনের ক্ষেত্রে উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। যেমন গত কয়েক বছর ধরে শিশু বাজেট প্রতিবেদন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। অথচ সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল যে, ২০২০ সালের মধ্যে তারা বাজেটের অন্তত ২০ শতাংশ বরাদ্দ নিশ্চিত করবে শিশুদের কল্যাণার্থে। কিন্তু বর্তমানে শিশুকেন্দ্রিক কী পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা খাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কোনো বরাদ্দ বাড়েনি। বরং সামাজিক নিরাপত্তা হিসেবে প্রদর্শিত অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশনবাবদ বরাদ্দ বেড়েছে। এতে করে দরিদ্র্য জনগোষ্ঠীর প্রতি কোনো সংবেদনশীলতা প্রকাশ পায়নি।
পি কে হালদারের বিপুল অর্থ পাচারের প্রসঙ্গ ধরে তিনি বলেন, কিছুদিন আগেও বহুল আলোচিত একটি কেস সম্পর্কে আপনারা ভালো জানেন। সেই ঘটনা নিয়ে যদি তখন আলোচনা না হয়ে এখন আলোচনা হতো, তাহলে দেখা যেত যে তার কোনো অপরাধই হয়নি। তিনি বাইরে যে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার মতো নিয়ে গেছেন, সেটা তিনি ঘোষণা দিয়ে ৭, ১০ বা ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করে দেশে আনতে পারতেন। এ ধরনের সুযোগ আমাদের নীতি ও নৈতিকতার সঙ্গে খাপ খায় না। সরকারের এ সিদ্ধান্তের ফলে ভবিষ্যতে দেশের টাকা উল্টো বাইরে নিয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এর আগেও আমরা দেখেছি বিভিন্ন ধরনের সুযোগ দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে, ওই প্রক্রিয়াও আমাদের তেমন রাজস্ব দেয়নি। তিনি আরও বলেন, এ ধরনের সুযোগ দিলে ভবিষ্যতে যারা বাইরে টাকা পাচার করার চিন্তা করতেন না, তারাও কিন্তু মনে করবেন যে এখানে ২৫ শতাংশ আয়কর বা ৪২ শতাংশ করপোরেট ট্যাক্স দিয়ে লাভ কী? আমি তো এটাকে বাইরে নিয়ে গেলে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ কর দিয়ে এটাকে বৈধ করে নিয়ে আসতে পারব।
মূল প্রবন্ধে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। এ হার ধরে রাখাও অসম্ভব। বাজারে গেলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যে দাম, তার সঙ্গে সরকারের তথ্যের মিল পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থমন্ত্রী হয়তো ভাবছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, করোনা মহামারিসহ বর্তমান সংকট দ্রæত কেটে যাবে। কিন্তু কোন জাদুর কাঠি দিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো হবে, সে পথ দেখাননি অর্থমন্ত্রী।
তিনি আরও বলেন, ব্যক্তি আয়ের ক্ষেত্রে করমুক্ত আয়ের সীমা তিন লাখ টাকাই আছে। এতে করে নি¤œধ্যবিত্তের ওপর করের চাপ বাড়বে। অথচ করোনার কারণে ২০২০ সালে উচ্চ আয়ের মানুষের কর ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছিল। আগামী অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাজেটেও সেটা বহাল আছে। এখানে উচ্চ আয়ের মানুষই সুবিধাটা পেল। নিন্মআয়ের মানুষকে কর সুবিধা দেয়া হয়নি, কর ন্যায্যতাও করা হয়নি।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী দেশের অর্থনীতির অসুখের লক্ষণ ধরতে পেরেছেন; কিন্তু যে ওষুধ প্রয়োগ করা দরকার, তার কাছে তা পর্যাপ্ত নেই, বা ওষুধ জানা নেই, অথবা যে মাত্রায় ওষুধের ডোজ দেয়া করা দরকার, সে মাত্রায় প্রয়োগ হচ্ছে না। যে চ্যালেঞ্জগুলোর কথা বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, সেটির সাপেক্ষে যে ধরনের উদ্যোগ নেয়া দরকার, আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তেমন উদ্যোগের অপ্রতুলতা বা অপর্যাপ্ততা দেখতে পেয়েছি।’
প্রস্তাবিত বাজেটে অবৈধ টাকা বৈধ করার সুযোগ থাকলেও কর ফাঁকি রোধ করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেই বলে মন্তব্য করেছেন সংগঠনটির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে কর ফাঁকি রোধে কঠোর কোনো পদক্ষেপের কথা বলা হলো না। প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপের কথাও উল্লেখ নেই। প্রস্তাবিত বাজেটে যারা সম্পদশালী, ধনিক শ্রেণি তাদের জয়টাই বেশি দেখা যাচ্ছে। সে অর্থে গরিবদের জন্য সুবিধা দেয়া হয়নি। এ বাজেটে সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি। মধ্যবিত্তের জন্য বাজেটে কিছু দেখা গেল না। ল্যাপটপের ওপর করহার বাড়ানো ঠিক হয়নি। এতে বোঝা যাচ্ছে, যারা বাজেট তৈরি করেন, তাদের বর্তমান বাজারের সঙ্গে কোনো সংযোগ নেই। এ সময় তিনি প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক কর ব্যবস্থাপনার দাবি তোলেন।