Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 9:59 pm

পাচার হওয়া টাকা মানুষের হক ফেরানোর চেষ্টা করছি

নিজস্ব প্রতিবেদক: বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ কর দিয়ে বৈধ করার সুযোগের সমালোচনা হলেও তা গায়ে মাখছেন না অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তার জবাব, যারা নিয়ে গেছেন, বুঝতেই পারেননি, না বুঝেই নিয়ে গেছেন। সে জন্য সাদা করার মাধ্যমে সেগুলোকে আমাদের অর্থনীতির মূলধারায় আনা হবে। অর্থমন্ত্রীর ভাষায়, বিদেশে পাচার হওয়া টাকা দেশের ‘মানুষের হক’, আর এই ‘হক’ তিনি ফিরিয়ে আনতে চান। যারা দেশ থেকে টাকা বিদেশে নিয়ে সম্পদ গড়েছেন, তারা বাজেটে প্রস্তাবিত সুযোগ নিয়ে সেই টাকা ফিরিয়ে আনবেন বলেই তার বিশ্বাস।

জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করার পরদিন রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে গতকাল সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন আ হ ম মুস্তফা কামাল। সেখানেই তার এ ব্যাখ্যা আসে। সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম। আরও ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন।

এ বাজেটের বিশাল ব্যয় মেটানোর জন্য অর্থ সংগ্রহে অর্থমন্ত্রী নতুন একটি পথ খুঁজে বের করেছেন। বিদেশ থাকা সম্পদের ‘দায়মুক্তির’ দিয়ে তিনি তা দেশে আনার ঘোষণা দিয়েছেন। এর ফলে ১৫ ও ৭ শতাংশ কর দিয়ে বিদেশে থাকা স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি দেশে সরকারের খাতায় বৈধ আয়ের তালিকায় যুক্ত করা যাবে, সেই অর্থ দেশেও আনা যাবে। ওই আয়ের উৎস জানতে চাওয়া হবে না। এ বিষয়ে কয়েকজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে মুস্তফা কামাল বলেন, ‘টাকা যদি পাচার হয়ে থাকে, সরকার তা ফেরত আনার চেষ্টা করছে। যেটা পাচার হয়ে গেছে সেটা এদেশের মানুষের হক। যদি বাধা দিই তবে আসবে না। যদি না আসে আমাদের লাভটা কী? এক্ষেত্রে অন্য দেশ যা করে, আমরা তাই করতে যাচ্ছি। ১৭টা দেশ দায়মুক্তি দিয়ে টাকা ফেরত আনছে।’ এরকম ব্যবস্থা যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, মালয়েশিয়া, নরওয়েতেও আছে বলে দাবি করেন অর্থমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ‘টাকার একটা ধর্ম আছে বা বৈশিষ্ট্য আছে। যেখানে কদর পায় সেখানে চলে যায়। টাকা যারা পাচার করে সুটকেসে করে পাচার করে না। এখন ডিজিটাল যুগ। বিভিন্নভাবে পাচার করে। কখনও কখনও বিভিন্ন কারণে টাকা চলে যায়। দেশের ভেতরে যারা এসব করে, তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আদালতে মামলা আছে।’ মুস্তফা কামাল বলেন, ‘সরকার তার কাজ করে। আপনারা জানেন, আমাদের প্রতিবন্ধকতা আছে। আপনারা মিডিয়াতে রিপোর্ট করলেই সবসময় ব্যবস্থা নিতে পারি না। আমাদের মাধ্যে যারা আছে, তাদের আমরা ব্যবহার করি। তাদের মাধ্যমে বিচারগুলো করি।’

অর্থমন্ত্রী বলেন, অর্থ ফেরত আনা নতুন কিছু না। অনেক দেশ এটি কার্যকর করেছে। ইন্দোনেশিয়া ২০১৬ সালে এমন একটি ব্যবস্থা নিয়েছিল। তখন তারা ৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশ থেকে নিয়ে এসেছিল। সব টাকা কালো টাকা না। কিছু টাকা বিভিন্ন কারণে কালো হয়ে যায়। আমরা বিশ্বাস করি, এবার আমরা সফল হবো। কালোটাকা সাদা করার সুযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কালোটাকা না বলে আমরা অপ্রদর্শিত টাকা বলছি। সেই টাকাগুলোর জন্যই আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছি।

কম্পিউটার-মোবাইলের দাম বাড়বে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, দেশের ভেতরে যদি কোনো জিনিস উৎপাদন হয় এবং তার কোয়ালিটি ভালো হলে সেগুলো দেশের ভেতরে আরও অগ্রাধিকার দিতে হবে। সে বিষয়গুলো বাজেটে উঠে এসেছে। এসব পণ্য বিদেশ থেকে আনাকে আমরা নিরুৎসাহিত করি। ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ধারণা আমরা এগিয়ে নেব।

অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘গত তিন বছরে আপনারা ঠকেননি। আমরা কখনই গরিব মারার বাজেট দিইনি।’ অনেকে এই বাজেটকে গরিব মারার বাজেট বলছে, আপনি এই বাজেটকে এক কথায় কী বলবেনÑ সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী এমন্ত মন্তব্য করেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, গরিব হওয়ার যন্ত্রণা আমি বুঝি। এবারের বাজেট ছাড়া আমি গত তিন বছরে তিনটা বাজেট দিয়েছি। এবারের বাজেটসহ গত তিনবারের কোনো বাজেটই গরিব মারার বাজেট ছিল না। আমরা সবসময় দেশের জনগণের কথা চিন্তা করে বাজেট দিই।

মন্ত্রী বলেন, এবার আমরা যে বাজেট প্রণয়ন করেছি, সেটি আমার মনে হয় দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বাজেট। সবাইকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যই এবারের বাজেট দেয়া হয়েছে। গত তিন বছর (২০১৮ থেকে ২০২১ সাল) আপনারা ঠকেননি। যা বলেছি, তা-ই হয়েছে। গরিব হওয়া যে কত কষ্টের সেটা আমি হাড়ে হাড়ে বুঝি। প্রত্যেকটা গরিব মানুষকে সামনে রেখেই বাজেট করি। সুতরাং, এটা নিয়ে আপনাদের দুশ্চিন্তা করার কারণ নেই। তিনি বলেন, ‘তবে একটা বিষয় মনে রাখবেন, যখনই কোনো চ্যালেঞ্জ আসে, চ্যালেঞ্জ শুধু একা আসে না, সুযোগও নিয়ে আসে। যেমনÑআমাদের রপ্তানি আয় বেড়েছে। এই মুহূর্তে বিশ্বের কোনো দেশে রপ্তানি আয়ে ইতিবাচক ধারা নিই। কিন্তু আমরা করছি। সেজন্যই বলি, চ্যালেঞ্জের সঙ্গে সঙ্গে অনেক সুযোগ তৈরি হয়।’

অর্থমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে আমাদের অনেক পণ্যের দাম একটু বেশি, এটা সত্য। তবে এটা হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে। এর ফলে সারাবিশ্বেই নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এখানে কারও হাত নেই। এ জন্য অনেকে গরিব মারার বাজেট বলছে। তবে আমরা গরিববান্ধবসহ দেশের সাধারণ জনগণকে গুরুত্ব দিয়েই আগামী বাজেট তৈরি করেছি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, আমরা বিভিন্ন সোর্সে খবর রাখি। তবে টাকা পাচার হওয়ার কোনো প্রমাণ পাইনি। অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, উৎপাদন বাড়ালে মানুষ বেশি খাবে। ডিমান্ড কমানোর কথা বলা হয়েছে। বাজেটের সাইজ কিন্তু কমানো হয়েছে, এর মাধ্যমে ডিমান্ড কমানো হয়েছে। ১ জুলাইয়ের পর কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা হবে। কিছু প্রকল্প আছে যেগুলোতে অল্প কিছু মানুষ বেনিফিট পায়, সেগুলো আমরা কমাব। সরকারের প্রধান বাজেট ঠিক থাকবে।

পাচার হওয়া টাকা দেশে ফেরত আনার বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, ট্র–থ কমিশনের কোনো আইনগত ভিত্তি ছিল না। কিন্তু এখন যেটা হচ্ছে, সেটা সংসদে আইনের মাধ্যমে হচ্ছে। ফলে ট্র–থ কমিশনের সঙ্গে বর্তমান দায়মুক্তির বিষয়টি তুলনীয় হতে পারে না।