ফারুক রহমান, সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলায় সরকারি খাল দখল করে নেট-পাটা দিয়ে পানি নিষ্কাশনে বাধাগ্রস্ত করায় নিন্মাঞ্চলের মানুষের মাঝে পানিবন্দি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এসব খালে নেট-পাটায় পানিপ্রবাহ বন্ধ থাকায় এলাকার ফসলের আবাদি জমি ও মাছের ঘের প্লাবিত হয়ে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা বর্তমানে মারাত্মক খারাপ অবস্থায় রয়েছে। উপজেলার অধিকাংশ খাল দখল করে নেট-পাটা দিয়ে মাছ চাষ করছে প্রভাবশালীরা। এর ফলে একদিকে খালগুলোতে পানির প্রবাহ না থাকায় খালের তলদেশ ভরাট হয়ে নাব্যতা হারানোর ফলে এলাকায় জলাবদ্ধতা বাড়ছে। ফলে মৌসুমে সামান্য বৃষ্টিতেই উপজেলার নি¤œাঞ্চলগুলোর জলাবদ্ধতা সৃষ্টির কারণে পানিবন্দি হয়ে পড়ছে এলাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসাকেন্দ্রগুলো।
সম্প্রতি সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসন কর্তৃক জেলার অভ্যন্তরীণ সব সরকারি খালের ইজারা বাতিলসহ পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ও খালগুলোর পানি প্রবাহের ধারা অব্যাহত রাখতে বিভিন্ন স্থানে অবৈধ নেট-পাটা উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা করা হয়। তবে দেবহাটার খালগুলোতে এখনও অবৈধ দখলদারদের নেট-পাটার কারণে বন্ধ রয়েছে।
এদিকে, উপজেলার পারুলিয়া-সখিপুরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত সাপমারা খালের বিভিন্ন স্থানে রাতদিন বিশাল নেটজাল পেতে রাখায় সম্প্রতি পুনঃখননকৃত খালটিতে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া কুলিয়া ইউনিয়নের লাবণ্যবর্তী খালের সঙ্গে সংযুক্ত গরুমারা খাল ও বাঁধের মুখ নামক স্থানে ইজারার নাম করে খালের মুখে মাটির বাঁধ দিয়ে পানির প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালীরা।
অভিযোগ উঠেছে, বছরের পর বছর ইজারাদার চক্রের স্বেচ্ছাচারিতা, জবরদখলকারীদের খাল দখল প্রবণতা ও খালে নেট-পাটা বসিয়ে প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে মাছ চাষ করছে। কিন্তু তাদের উচ্ছেদে উপজেলা প্রশাসন পদক্ষেপ না নেওয়ায় বর্তমানে নাব্য হারিয়ে অনেকটা বন্ধ হয়ে গেছে দেবহাটার এসব খাল।
জানা গেছে, দেবহাটার কুলিয়া ইউনিয়নসহ আশেপাশের কয়েকটি এলাকার পানি নিষ্কাশন লাবণ্যবতী খালের ওপরেই নির্ভরশীল। যুগ যুগ ধরে লাবণ্যবতী খালের মাধ্যমে বহু এলাকার পানি নিষ্কাশিত হয়ে আসছে ইছামতি নদীতে। খালটি হাড়দ্দাহ সুইস গেট থেকে ইছামতি নদীর সঙ্গে সংযুক্ত। অপরদিকে সাতক্ষীরা শহরের প্রাণসায়র ও কলকাতা খাল থেকে শাখা খাল হিসেবে চরবালিথা খাল, কদমখালী খাল, ঝিনুকঘাটা খাল এসে মিশেছে লাবণ্যবতীতে।
এদিকে, উপজেলার কুলিয়া বাঁধের মুখ থেকে লাবণ্যবতীর দুটি শাখা কামটপাড়া সুবর্নাবাদ ও শশাডাঙ্গা হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে। লাবণ্যবতী খালের কামটপাড়া এলাকার খালটির একটি শাখা মুখ ইজারার নামে মাটির বেড়িবাঁধ দিয়ে পানির প্রবাহ বন্ধ করে ঘের তৈরি করে মাছ করছেন স্থানীয় প্রভাবশালী মো. ময়নুদ্দীনের ছেলে মো ইব্রাহিম। লাবণ্যবতীর অন্যান্য শাখা খালগুলোর মধ্যে সুবর্নাবাদ, টিকিট, পুঁটিমারী হয়ে প্রবাহিত খালের কয়েক মিটার পর পর শতশত অবৈধ নেট-পাটা দিয়ে মাছ চাষের নামে খালের পানি প্রবাহ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা বাঁধাগ্রস্ত করে চলেছে এলাকার শতাধিক প্রভাবশালী।
উপজেলার পারুলিয়া-সখিপুরের সাপমারা খাল থেকে বেশ কয়েকটি শাখা হলদারখালি, চেংমারি, মাঝেরহাটি হয়ে প্রবাহিত হলেও বর্তমানে অবৈধ দখলদারদের কবলে পড়ে ছে। এসব এলাকার দখলদাররা নেট-পাটা দিয়ে খাল বন্ধ করে মাছের ঘেরে পরিণত করেছে।
অপরদিকে উপজেলার চরশ্রীপুর ইছামতি নদী থেকে সদর ইউনিয়নের গোপাখালী হয়ে সখিপুর ইউনিয়নের কেওড়াতলার মধ্য দিয়ে তিলকুড়া পর্যন্ত প্রবাহিত মতিঝিল খালটিও ইজারাদারদের নামে ভূমিদস্যুদের কবলে পড়েছে এমনটাই দাবি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসীর। খালটির বিভিন্ন স্থানে আড়াআড়ি অবৈধ নেট-পাটা দিয়ে এবং মাছ শিকার করতে নেটজাল বসিয়ে খালটির পানিপ্রবাহ ব্যাহত করে চলেছে অসাধু চক্র। খালের দু-পাশ ভরাট করে অবৈধ জবরদখলকারীরা প্রতিনিয়ত খাল দখল করছে।
সখিপুরের মাঘরী চন্ডীপুরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত মাঝের খাল এবং সদর ইউনিয়নের শ্রীপুর হয়ে রতেœশ্বরপুর দিয়ে প্রবাহিত খাল দুটির বিভিন্ন স্থানে নেট-পাটা দিয়ে পানি নিষ্কাশন বাঁধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। রতেœশ্বরপুরের শেষের দিকে খালটিতে স্থানীয় প্রভাবশালী ওয়াহেদ ঢালী ও তার মো. সুজা, মনিরুল ইসলামসহ প্রভাবশালীরা খালটির মুখ মাটির বাঁধ দিয়ে সম্পূর্ণ খালটি মাছের ঘেরের মধ্যে জবরদখল করে নিয়েছে।
এছাড়া নওয়াপাড়া ইউনিয়নের চাঁদপুরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ধাঁপার খালটিতে বয়সা, বাবুরাবাদ, ঢেপুখালী, দাইবুড়ি, সন্যাসীতলা, বড়হুলা, কামিনীবসুসহ এলাকাভিত্তিক একাধিক নামে প্রবাহিত হচ্ছে। নওয়াপাড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার পানি খালটির মাধ্যমে সখিপুরের সাপমারা খালের মধ্যে নিষ্কাশিত হয়। সেখানে নেট-পাটা, দখলদারিত্ব আর ইজারার নামে মাছের ঘের হিসেবে ব্যবহার করছে এলাকার প্রভাবশালী। এর ফলে একে খালটি মৃতপ্রায় অবস্থা। অপরদিকে এলাকাবাসীর পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, দীর্ঘদিন দেবহাটা উপজেলার এসব সরকারি খাল প্রভাবশালী, সুবিধাবাদীদের জবরদখলের ফলে খালগুলো অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। পাশপাশি অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ ও নেট-পাটা অপসারণে প্রশাসনিক পদক্ষেপ না থাকায় ভূমিদস্যুরা খালগুলো দখলে নিয়ে নিচ্ছে। এর ফলে উপজেলার পানি নিষ্কাশন ভেঙে পড়েছে। আর পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাঁধাগ্রস্ত হওয়ায় খালগুলোর তলদেশ ভরাট হয়ে সেগুলো নাব্যতা হারিয়ে মৃতপ্রায় এসব খাল আগামীতে পুরোটাই দখলদারদের হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। স্থানীয়রা খালগুলো থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ আর নেট-পাটা অপসারণে প্রশাসনের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
এ বিষয়ে দেবহাটা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সাজিয়া আফরিনের সঙ্গে মোবাইলে সরকারি খাল ও জলাশয়ে নেট-পাটা অপসারণ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অফিসে আসলে বিষয়টি নিয়ে কথা বলা যাবে।