পানির দামে শুল্কায়ন, শুল্ক সুবিধার বোর্ডে বাজার সয়লাব

রহমত রহমান: ডুপ্লেক্স বোর্ড আমদানি আর শুল্কায়নে চলছে তেলেসমাতি। আমদানিকারকরা প্রতি কেজি ঘোষণা দিচ্ছে আধা থেকে পৌনে এক ডলারে। আর কাস্টম হাউসও শুল্কায়নে এক ডলারের ওপরে উঠতে পারছে না। তাছাড়া একেক কাস্টম হাউসে ঘোষণা আর শুল্কায়ন হচ্ছে একেক ধরনের। পানির দামে ঘোষণা দেয়া বোর্ড আমদানি আর শুল্কায়নে যেন কোনো নিয়মই নেই। এই বোর্ড বাজারে বিক্রি হচ্ছে ঘোষিত আর শুল্কায়ন মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামে। সস্তায় আমদানি করে বেশি দামে বিক্রি করা ডুপ্লেক্স বোর্ড থেকে সরকার তেমন রাজস্ব পাচ্ছে না। তাই ডুপ্লেক্স বোর্ডের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য নির্ধারণ করার অনুরোধ জানিয়েছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা।

এছাড়া বন্ড সুবিধায় আমদানি করা বেশিরভাগ বোর্ড চলে যাচ্ছে খোলাবাজারে, যা বিক্রি হচ্ছে তুলনামূলক অনেক দামে। বন্ড লাইন্সেসধারী অসাধু ব্যবসায়ীরা আমদানি করে সরাসরি খোলাবাজারে বিক্রি করছেন। ফলে বন্ডের বোর্ডে বাজার সয়লাব হয়ে আছে। বর্তমানে দেশে উৎপাদিত হচ্ছে ডুপ্লেক্স বোর্ড। কিন্তু কম মূল্যে আমদানি করা ও বন্ড সুবিধার বোর্ড বাজারে কম দামে বিক্রি হচ্ছে। ফলে স্থানীয় উৎপাদনকারীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, অন্যদিকে সরকার ডুপ্লেক্স বোর্ড থেকে তেমন রাজস্ব পাচ্ছে না। এ জটিলতা নিরসনে শিগগির ব্যবস্থা নিতে এনবিআরকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

এনবিআর সূত্রমতে, ডুপ্লেক্স বোর্ড একেক কাস্টম হাউস দিয়ে একেক মূল্যে শুল্কায়ন হচ্ছে। এ জটিলতা নিরসনে ডুপ্লেক্স বোর্ডের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য নির্ধারণে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে কাস্টমস মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেটকে চিঠি দেয়া হয়। কাস্টমস মূল্যায়ন মূল্য নির্ধারণে সব কাস্টম হাউসের প্রতিনিধিদের নিয়ে ২৫ জুলাই সভা করে। এতে সভাপতিত্ব করেন কমিশনার মোহাম্মদ এনামুল হক। সভায় কমিশনার বলেন, আমদানি করা পণ্যের শুল্কায়নে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ পাঁচটি পদ্ধতি ব্যবহার করেন। এর মধ্যে কাস্টম হাউসগুলো ডুপ্লেক্স বোর্ড শুল্কায়নে কোনো পদ্ধতি ব্যবহার করেন, তা হাউসের প্রতিনিধিদের কাছে জানতে চান।

কমিশনার বলেন, ডেটাবেজ অনুযায়ী বিভিন্ন কাস্টম হাউস ডুপ্লেক্স বোর্ড রেকর্ড ভ্যালুতে কেন ছাড় দিচ্ছে। শুল্ক মূল্যায়ন বিধিমালা, ২০০০ অনুযায়ী সরাসরি রেকর্ড মূল্যে শুল্কায়নের সুযোগ আছে কি না। কী কারণে শুল্কায়নের পাঁচটি পদ্ধতি বাদ দিয়ে অন্য পদ্ধতি ব্যবহার করে ডুপ্লেক্স বোর্ড শুল্কায়ন করতে হলো? বিষয়টি জানতে কাস্টম হাউসগুলোকে চিঠি দেয়া হলেও কোনো ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। সভায় উপস্থিত হাউসের প্রতিনিধিরা এ বিষয়ে কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। কে কত রেকর্ড ভ্যালুতে ডুপ্লেক্স বোর্ড ছাড় করেছেÑ তা জানতে চান তিনি। এছাড়া ডুপ্লেক্স বোর্ডে তৈরিতে ব্যবহƒত উপকরণের মূল্য সম্পর্কে তথ্য উপস্থাপনের অনুরোধ করেন কমিশনার।

সভায় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সহকারী কমিশনার আফরিন জাহান নাওমিন বলেন, ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা পাল্প প্রতি কেজি শূন্য দশমিক ৬৫ থেকে শূন্য দশমিক ৮৪ ডলার পর্যন্ত ওঠানামা করে। এ পাল্প হোয়াইট ব্যাক ডুপ্লেক্স বোর্ড তৈরিতে ব্যবহƒত হয়। গ্রে ব্যাক ডুপ্লেক্স বোর্ড বানাতে ব্যবহƒত পাল্পের দাম পড়ে প্রতি কেজি শূন্য দশমিক ৪৯ থেকে শূন্য দশমিক ৬০ ডলার। রোল আকারে আমদানি করা হোয়াইট ব্যাক ডুপ্লেক্স বোর্ড প্রতি কেজি শূন্য দশমিক ৬০ ডলার ও গ্রে ব্যাক ডুপ্লেক্স বোর্ড প্রতি কেজি শূন্য দশমিক ৬৫ ডলারে শুল্কায়ন করা হয়েছে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস দিয়ে সর্বোচ্চ পরিমাণ ডুপ্লেক্স বোর্ডের চালান প্রতি কেজি শূন্য দশমিক ৭৯ ডলারে শুল্কায়ন করা হয়েছে।

আইসিডি কমলাপুর কাস্টম হাউসের প্রতিনিধি জানিয়েছেন, এ হাউস দিয়ে গত তিন মাসে একমাত্র আকিজ গ্রুপ কোরিয়া থেকে ডুপ্লেক্স বোর্ড আমদানি করেছে। ঘোষণা দিয়েছে প্রতি কেজি শূন্য দশমিক ৬০ ডলারে। অন্য কোনো কোম্পানি বোর্ড আমদানি করেনি।

বেনাপোল কাস্টম হাউসের প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গ্রে ব্যাক ডুপ্লেক্স বোর্ড প্রতি কেজি শূন্য দশমিক ৫৯ ডলার থেকে শূন্য দশমিক ৬২ ডলার ঘোষণায় আমদানি হয়েছে। তবে শুল্কায়ন হয়েছে শূন্য দশমিক ৮৭ ডলারে। আর হোয়াইট ব্যাক ডুপ্লেক্স বোর্ড প্রতি কেজি শূন্য দশমিক ৯৭ থেকে এক ডলার ঘোষণায় আমদানি হয়েছে। শুল্কায়ন হয়েছে এক দশমিক শূন্য তিন ডলারে।

কমিশনার বলেন, প্রাইম গ্রেডের উড পাল্প, যা ডুপ্লেক্স বোর্ড তৈরিতে ব্যবহƒত হয়। ডুপ্লেক্স বোর্ডের মোট আমদানির ৮০ শতাংশ পণ্য চালান কেজি প্রতি শূন্য দশমিক ৬৫ ডলারে শুল্কায়ন করা হয়। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কেজি প্রতি শূন্য দশমিক ৭৯ ডলারে সর্বোচ্চ শুল্কায়ন কেন করা হয়েছেÑতার কোনো ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, কাস্টমস মূল্যায়নের একটি দল খোলাবাজারে ডুপ্লেক্স বোর্ডের বাজারদর যাচাই করেছে। যাতে দেখা গেছে, আমদানি করা ডুপ্লেক্স বোর্ড সয়লাব। দাম তুলনামূলক কম। এসব বোর্ড বন্ড সুবিধায় আমদানি করা বা কম মূল্য ঘোষণা দিয়ে আমদানি করা। সেজন্য বিভিন্ন উৎপাদকের দেয়া ঘোষিত মূল্যের চোয়েও কম মূল্যে বাজারে বোর্ড পাওয়া যাচ্ছে। কমিশনার বলেন, ভারত ও ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা উড পাল্পের মূল্য ব্যবহার করে তা থেকে ডুপ্লেক্স বোর্ডের উৎপাদন খরচ বের করা সম্ভব। প্রতি কেজি এক হাজার ১০০ কেজি পাল্প থেকে এক টন ডুপ্লেক্স বোর্ড পাওয়া যায়। শুল্কায়নের কম্পিউটিং মেথড ব্যবহার করে পাল্পের সঙ্গে বাকি উপকরণ যোগ করে উৎপাদন খরচ কত হবেÑতা বের করা যাবে।

অন্যদিকে, স্থানীয় ডুপ্লেক্স বোর্ড উৎপাদনকারীরা জানিয়েছেন, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত গ্রে ব্যাক প্রতি টন ৪০ থেকে ৪২ হাজার টাকা এবং হোয়াইট ব্যাক প্রতি টন ৪৪ থেকে ৪৬ হাজার টাকা মূল্য ঘোষণা দেয়া হয়। উন্নত মানের পিউর উড পাল্প বা কটন পাল্প কেবল উৎকৃষ্ট মানের কাগজ, আর্ট কার্ড প্রভৃতি তৈরিতে ব্যবহƒত হয়। ডুপ্লেক্স বোর্ড সবসময় রিসাইকেল পাল্পের সঙ্গে অন্যান্য কিছু উপকরণ যোগ করে তৈরি করা হয়। এছাড়া হোয়াইট ব্যাক ডুপ্লেক্স বোর্ড তৈরিতে বোর্ডের উভয় পাশে মসৃণ প্রলেপ যুক্ত করার জন্য কিছু পিউর পাল্প ও কিছু কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়।

অন্যদিকে স্থানীয় বাজারে আমদানি করা ডুপ্লেক্স বোর্ডের বিক্রয় মূল্য অস্থিতিশীল। বাজার যাচাইয়ে দেখা গেছে, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ডুপ্লেক্স বোর্ড মূসক চালানের মাধ্যমে প্রতি টন ৫০ থেকে ৫২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। আর আমদানি করা ডুপ্লেক্স বোর্ডে মূসক চালান দেয়া হয় না। বাজারে সরবরাহ করা হলে তা বিক্রি হয় প্রতি টন ৪৫ থেকে ৬০ হাজার টাকায়। উন্নতমানের হোয়াইট ব্যাক ডুপ্লেক্স ও আর্ট কার্ডের প্রতি টনের মূল্য ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা।

স্থানীয় উৎপাদনকারীরা জানিয়েছেন, বন্ড সুবিধার ডুপ্লেক্স বোর্ড যখন বাজারে আসে, তখন স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বোর্ডের দাম পড়ে যায়। বন্ড সুবিধার বোর্ড বিক্রিতে মূসক চালান দেয়া হয় না। বন্ডের পণ্য অনেক সময় সরাসরি বিক্রয় কেন্দ্রে থাকে না। ক্রেতার সঙ্গে দর হলে গোডাউন থেকে ক্রেতার ঠিকানায় পৌঁছে দেয়া হয়। বাণিজ্যিক আমদানিকারকের শুল্কায়ন মূল্য বাড়ানো হলেও কোনো লাভ হবে না। কারণ বন্ড সুবিধার বোর্ড নানাভাবে বাজারে চলে আসছে। এতে একদিকে রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে স্থানীয় উৎপাদনকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সেক্ষেত্রে সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিলে স্থানীয় উৎপাদনকারীরা সুরক্ষা পাবেন।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০