মো. আরাফাত রহমান: বাংলাদেশের জীবনধারা পানিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। পানি বাংলাদেশের জনগণের কল্যাণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। পানি প্রাকৃতিক পরিবেশকে সংরক্ষণ এবং লাখ লাখ মানুষের জীবিকা নির্বাহ করতে সহায়তা করছে। দুর্ভাগ্যবশত পানি একটি সীমিত সম্পদ এবং কোনোক্রমেই প্রকৃতির অন্তহীন দান হিসেবে পানির যথেচ্ছা ব্যবহারের অবকাশ নেই। পানির একক বৈশিষ্ট্যের কারণে এর যেকোনো ব্যবহার অন্য ব্যবহারকে প্রভাবিত করে। জীবনধারণের জন্য পানির প্রাপ্যতা, পরিমাণগত ও গুণগত উভয় বিচারেই একটি মৌলিক মানবাধিকার। তাই সমাজের কোনো অংশের স্বার্থ বিঘ্নিত না করে পানির যথাযথ সুষম ব্যবহারের নিশ্চয়তা বিধান একান্ত কাম্য।
বৃষ্টি, ভূপরিস্থ অথবা ভূগর্ভস্থ সব রকম পানির ব্যবহারযোগ্য অবস্থায় সহজপ্রাপ্যতার জন্য টেকসই উন্নয়নের প্রয়োজন, যার দায়িত্ব সবাইকে ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগতভাবে অবশ্যই কাঁধে নিতে হবে। পানি উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার মূল দায়িত্ব প্রধানত তার ব্যবহারকারীদের ওপর বর্তায়। সবার অংশগ্রহণের সমান সুযোগ নিশ্চিত করে পানি খাতের বেসরকারি বিনিয়োগ অত্যন্ত জোরালোভাবে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। পানি সম্পদের উন্নয়নে সাধারণত বড় ধরনের বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়ে। ফলে এ খাতে সরকারি বিনিয়োগের আবশ্যিকতা যুক্তিযুক্ত হয়ে ওঠে। সমাজের সামগ্রিক চাহিদা পূরণ, দারিদ্র্য বিমোচন এবং মানব সম্পদ উন্নয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও পরিবেশগত দিক সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কারণে সরকারের ভূমিকা অতন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পানির গুরুত্বকে তুলে ধরার জন্য জাতিসংঘ প্রতি বছর ‘বিশ্ব পানি দিবস’ পালন করে। ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২২ মার্চকে বিশ্ব পানি দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে জাতিসংঘ পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্মেলনের এজেন্ডা ২১-এ প্রথম বিশ্ব পানি দিবস পালনের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। ১৯৯৩ সালে প্রথম বিশ্ব পানি দিবস পালিত হয় এবং তার পর থেকে এই দিবস পালনের গুরুত্ব ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো এই দিনটিকে নিজ নিজ রাষ্ট্রসীমার মধ্যে জাতিসংঘের পানিসম্পদ সংক্রান্ত সুপারিশ ও উন্নয়ন প্রস্তাবগুলোর প্রতি মনোনিবেশের দিন হিসেবে পালন করে।
জাতীয় পানি নীতি বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। এ ধরনের নীতির অভাবে ইতোমধ্যে দেশের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের বিপুল ক্ষতি সাধিত হয়েছে। উন্নয়ন কর্মসূচি এবং পানি সম্পদ ব্যবহারে সমন্বয়হীনতার ফলে বহু প্রতিকূল ও অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের মতো পানিনির্ভর দেশের সার্বিক উন্নয়নের পথে এ ধরনের মারাত্মক পরিস্থিতির দ্রুত নিরসন হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশে পানি সম্পদ আহরণ, ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহারে শৃঙ্খলা প্রবর্তন করে বিরাজমান র্বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির অবসান ঘটানো জাতীয় পানি নীতির উদ্দেশ্য।
এ নীতির মাধ্যমে দেশের পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক, সমন্বিত ও সুষম ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করার পথে নতুন দ্বার উšে§াচিত হয়েছে। এ নীতির বাস্তবায়ন পদ্ধতির রূপরেখা এতে বিধৃত হয়েছে। এ নীতি আন্তর্জতিকভাবে স্বীকৃত পানি ব্যবস্থাপনার নিয়ম, নীতি ও মানের নিরিখে উন্নয়নগামী একটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাহিদার সফল সমন্বয় সাধনে সক্ষম হয়েছে। পরিমাণগত ও গুণগত মানে পানির সহজপ্রাপ্যতা একটি মৌলিক নাগরিক অধিকার এবং তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য অতীতে বাংলাদেশে কোনো পানি নীতি ছিল না। সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। আজ আমাদের উপলব্ধি হয়েছে পানি প্রকৃতির অফুরন্ত দান নয়; বরং একটি সীমিত সম্পদ এবং সবার প্রয়োজন মেটাতে এর আহরণ, উন্নয়ন ও ব্যবহার সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে হওয়া প্রয়োজন। এই উপলব্ধি থেকেই ১৯৯৯ সালে জাতীয় পানি নীতি প্রণীত হয়। ভূগর্ভস্থ ও ভূপরিস্থ পানির সমন্বিত ব্যবহারের ওপর এই নীতিতে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। পানি সংক্রান্ত বহু সমস্যা ও অনিষ্পন্ন বিষয়াদি সমাধনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা আজ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
এর মধ্যে সবচেয়ে সংকটপূর্ণ হচ্ছে পর্যায়ক্রমিক বর্ষাকালে বন্যা ও শুকনো মৌসুমে পানির দুষ্প্রাপ্যতা, ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি ও জনসংখ্যার কারণে পানির ঊর্ধ্বমুখী চাহিদা, নদ-নদীতে ব্যাপক পলিমাটি পড়ে ভরাট হওয়া এবং নদীভাঙন। লবণাক্ততা, ভূপরিস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানির মানের ক্রমাবনতি ও পানিদূষণসহ পানির সামগ্রিক গুণগত মানের ব্যবস্থাপনা এবং ভৌত ও জৈব পরিবেশ ব্যবস্থা সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। সীমিত সম্পদের মধ্যে বহুমুখী পানির চাহিদা মেটানো, দক্ষ ও সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল পানি ব্যবহারের উন্নয়ন, সরকারি ও বেসরকারি খাতের ভূমিকা চিত্রণ ও উপযুক্ত ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের বিকেন্দ্রীকরণের জরুরি তাগিদ রয়েছে।
সীমান্তের বাইরে উৎপত্তিহেতু সংশ্লিষ্ট নদীর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অভাব, ব-দ্বীপস্থ সমতল ভূমির জটিল ব্যবস্থাপনা এবং অবকাঠামো নির্মাণে নিষ্কণ্টক জমির তীব্র অভাবসহ সমস্ত সীমাবদ্ধতার মধ্যেই কাজ সম্পাদন করতে হবে। উল্লিখিত সীমাবদ্ধতার মধ্যে পানিসম্পদের উন্নয়ন এবং তার যুক্তিসংগত ব্যবহারের ব্যাপকভিত্তিক নীতিমালা জাতীয় পানি নীতিতে বিধৃত হয়েছে। বৃহত্তর সমাজ ও ব্যক্তির কল্যাণের লক্ষ্যে পানি সম্পদের সর্বোত্তম উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে সরকারি ও বেসরকারি খাতের ভবিষ্যৎ কার্যক্রম নিরূপণে এই নীতিমালা দিকনির্দেশনা প্রদান করবে।
যেহেতু মানুষের জীবনধারণ, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষার জন্য পানি একান্ত প্রয়োজনীয়, সে কারণে ব্যাপক, সমন্বিত ও সুষম ভিত্তিতে দেশের পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সব পদ্ধতি ও কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা, জনস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা, জনগণের উন্নততর জীবনমান এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষার যাবতীয় লক্ষ্যগুলো পরিপূরণের উদ্দেশ্যে নিরবচ্ছিন্ন অগ্রযাত্রার জন্য এই নীতিমালা রচিত হয়েছে। পানির মালিকানা রাষ্ট্রের ওপর ন্যস্ত, ব্যক্তির ওপর নয়। পানির সুষম বণ্টন, দক্ষ উন্নয়ন ও ব্যবহার এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে সুষ্ঠু বণ্টনের অধিকার সরকার সংরক্ষণ করে।
খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশগত শুদ্ধতার প্রতি হুমকি সৃষ্টিকারী ভূগর্ভস্থ পানি স্তর দূষেণর মতো প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট বিপর্যয়কালে সরকার পানির ব্যবহার পুননির্ধারণ করার নির্দেশ দিতে পারে। পানি সরবরাহ প্রশ্নে বণ্টনবিধি হবে আনুষ্ঠানিক পদ্ধতি। এ পদ্ধতির ভিত্তিতেই নির্ধারিত হবেÑকে পানি পাবে, কী উদ্দেশ্যে পাবে, কী পরিমাণ পাবে, কোন সময় ও কত সময়ের জন্য পাবে এবং কোন পরিস্থিতিতে পানির ব্যবহার সংকুচিত হতে পারে। শুষ্ক মৌসুমে নদীবক্ষে প্রাপ্যতার প্রয়োজন, নদী থেকে উত্তোলন এবং ভূগর্ভস্থ আধার থেকে আহরণ ও পুনর্ভরণের লক্ষ্যে বণ্টনবিধি গড়ে তুলতে হবে।
প্রত্যেক অঞ্চলের জন্য খরা পরিবীক্ষণ ও আপৎকালীন পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে হবে। বৃষ্টির পানি, ভূপরিস্থ পানি ও ভূগর্ভস্থ পানির সংযোজক ব্যবহার, পানির চাহিদা পূরণের বিকল্প পন্থাগুলোকে যথাযথ বিবেচনা সাপেক্ষে এবং পৌনঃপুনিক মৌসুমি পানির ঘাটতির অভিজ্ঞতার আলোকে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। আপৎকালীন পরিকল্পনায় অগ্রাধিকার অনুসারে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার সীমিত রাখার পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যবহারকারীর নির্দিষ্ট অধিকার সংরক্ষণের লক্ষ্যে যথোপযুক্ত আইন প্রণয়ন প্রয়োজন।
বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকা উন্নত খাবার পানির সংকটে ভূগছে। ভূপরিস্থ পানি সাধারণত দূষিত এবং ভূগর্ভস্থ পানি, যা এখন পর্যন্ত নিরাপদ খাবার পানির উৎকৃষ্ট উৎস, তাও দেশের বহু স্থানেই আর্সেনিক দূষণে সংক্রমিত হয়েছে। সেচের জন্য ব্যাপক মাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে বহু এলাকায় পানির স্তর হস্তচালিত নলকূপের কার্যকর নাগালের নিচে নেমে গেছে। কৃষিতে ব্যবহƒত রাসায়নিক পদার্থ অগভীর স্তরে চুঁইয়ে প্রবেশ করার ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার পানি মানুষ ও প্রাণীর খাবার অনুপযোগী হয়ে পরছে। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে সমুদ্র থেকে লবণাক্ততা ভূমির গভীরে প্রবেশ করে ভূগর্ভস্থ পানিকে ব্যহারের অযোগ্য করে তুলছে।
ব্যাপকভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে শহর ও নগর এলাকায় পানির স্তর অবনমিত হওয়ার সমস্যার সম্মুখীন। পানি সরবরাহ ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এসব সমস্যা জনস্বাস্থ্যের ওপর নিশ্চিত প্রভাব ফেলছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দূষিত খাবার পানি থেকে উদ্ভূত ডায়রিয়া গ্রাম অঞ্চলে মৃত্যুর একটি বড় কারণ। নগর এলাকার রোগ-ব্যাধির প্রাথমিক কারণ যথাযথ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও নিষ্কাশন সুবিধার অভাব, অপর্যাপ্ত পানি সরবরাহ এবং অপ্রতুল স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা সংক্রান্ত শিক্ষা। নিরাপদ পানির উৎস দূরবর্তী হওয়ায় গ্রামের মহিলাদের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে পানি সংগ্রহে বিশেষ দুর্ভোগ পোহাতে হয়, যা তাদের স্বাস্থ্য ও উৎপাদনশীলতার ওপর তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলছে।
সুতরাং, পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ও সংগঠনকে পরিবেশগত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির বিষয়টিকে জোরদার করতে হবে। এটাও নিশ্চিত করতে হবে, তারা তাদের কাজ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে পরিবেশগত সম্পদের সংরক্ষণ করবে ও স্থিতাবস্থায় ফিরিয়ে আনবে। পরিবেশগত প্রয়োজনীয়তা ও উদ্দেশ্যগুলো সম্পদ ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সমভাবে বিবেচিত হবে। জাতীয় পানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার জন্য বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপক সমন্বয় প্রয়োজন। পরিবেশগত সম্পদ ব্যবস্থাপনার নীতি ও নির্দেশনাগুলোর কার্যকর বাস্তবায়ন ও প্রশাসেনর জন্য যথার্থভাবে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান আবশ্যক।
সহকারী কর্মকর্তা
ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয় arafatrahman373@gmail.com