বাংলাদেশের ব্যাটারির মান উন্নত। এটি এখন শিল্প খাত হিসেবে বিস্তৃত হচ্ছে। বাংলাদেশ অ্যাকিউমুলেটর অ্যান্ড ব্যাটারি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএবিএমএ) তথ্য অনুযায়ী, ছোট-বড় মিলিয়ে দেশে প্রায় ২০টি ব্যাটারি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মতো সক্ষমতা রয়েছে এই ব্যাটারি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর। দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানির আশা করছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। শুনতে সহজ মনে হলেও অনেকটা সময় নিয়ে ধীরে ধীরে আজকের এ অবস্থানে এসেছে খাতটি। এই অবস্থানে আসার পেছনে খাতসংশ্লিষ্ট মানুষ ও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এবং গ্রুপের বেশ ভূমিকা রয়েছে। এদের মধ্যে অন্যতম পান্না গ্রুপ। দেশে ব্যাটারি খাতের সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রটি তৈরির পেছনে পান্না গ্রুপের অবদান প্রথম সারিতে। বলা যায়, বাংলাদেশের ব্যাটারি খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে পান্না গ্রুপ।
পান্না গ্রুপের ব্যবস্থাপনা টিমের নেতৃত্বে রয়েছেন মো. লোকমান হোসেন। বাংলাদেশে ব্যাটারিশিল্পের পথিকৃৎদের একজন তিনি। মাত্র আট বছর বয়সে পুরান ঢাকার আল মদিনা ব্যাটারি কারখানায় সাপ্তাহিক ১০ টাকা বেতনে কাজ শুরু করেন তিনি। পারিশ্রমিকের সঙ্গে খাবারও পেতেন। কারখানাটি তেমন উন্নত ছিল না। সেখানে হাতে ব্যাটারি তৈরি করা হতো। কাজ শেখার পর মাসিক ১৫০ টাকা বেতন পেতেন। এভাবে চলতে থাকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত। ওই বছর উপার্জিত সাড়ে তিন হাজার টাকা বিনিয়োগ করে ব্যাটারি কারখানায় কয়লা সরবরাহ শুরু করেন। এর মধ্য দিয়ে ব্যবসায় হাতেখড়ি তার। গড়ে তোলেন সিসা পুনঃপ্রক্রিয়াজাত ব্যাটারি কারখানা। ধীরে ধীরে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার কঠোর পরিশ্রম, সততা ও জবাবদিহির ফসল আজকের পান্না গ্রুপ। এই গ্রুপের প্রাণপুরুষ তিনিই। বর্তমানে তার গ্রুপে দেশি-বিদেশি প্রায় ১৫ হাজার কর্মী রয়েছেন। পান্না গ্রুপে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন জোনাকি বেগম।
সমাজ, গ্রাহক ও কর্মীদের জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছে গ্রুপটি। নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত গ্রুপটির কর্মপরিবেশ। কারখানায় শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। তাদের জন্য কারখানায় সার্বক্ষণিক তিনজন চিকিৎসক রয়েছেন। শ্রমিকদের ক্যালরি নিশ্চিতে প্রতিদিন প্রত্যেক শ্রমিকের জন্য এক গ্লাস দুধ, একটি ডিম, ৫০ গ্রাম কাঁচা ছোলা, দুই পিস পাউরুটি ও একটি কলার ব্যবস্থা রেখেছে কর্তৃপক্ষ। কর্মীদের জন্য প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশের একটি অংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়। যে বছর যেমন লাভ হয়, সে বছর সে হারে কর্মীদের ‘প্রফিট বোনাস’ দেওয়া হয়। সম্পূর্ণরূপে শ্রম আইনে অনুসরণ করে থাকে গ্রুপটি। চালু রয়েছে গোষ্ঠীবিমা। পান্না গ্রুপের সব কারখানা পরিবেশবান্ধব বলে সুবিদিত। পরিবেশের কথা মাথায় রেখে এখানে সার্বক্ষণিক ইটিপি চালু রাখা হয়। বায়ুদূষণ রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পানি বিশুদ্ধকরণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় এখানে।
কঠোর পরিশ্রম, উদ্ভাবনী শক্তি ও গুণগত মানের ওপর ভর করে টেকসই প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে বদ্ধপরিকর গ্রুপটি। তবে সবার ওপরে দেশের গ্রাহকদের সন্তুষ্টিকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে তারা। প্রতিষ্ঠার শুরু হতে উৎপাদনের সব পর্যায়সহ সরবরাহ সবখানে স্বচ্ছতা বজায় রাখা হয়েছে এখানে। কাঁচামাল, উৎপাদন প্রভৃতির বেলায় সর্বোচ্চ মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সময়মতো পণ্য সরবরাহে বদ্ধপরিকর তারা। ব্যবসায় নীতি-নৈতিকতার কারণে অল্প সময়ের মধ্যে দেশের শীর্ষস্থানীয় গ্রুপে পরিণত হয় পান্না গ্রুপ। বর্তমানে ব্যাটারির অন্যতম জনপ্রিয় ‘ভলভো’ ব্র্যান্ডের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এটি। এ ব্র্যান্ডের ব্যাটারি দীর্ঘস্থায়ী ও সাশ্রয়ী, অধিক কার্যক্ষমতাসম্পন্ন। গুণগত মানে সেরা ব্যাটারি বাজারজাতকরণের পাশাপাশি ব্যবহƒত ব্যাটারি রিসাইক্লিং করে অন্য প্রস্তুতকারকদের কাছে ব্যাটারির কাঁচামাল সিসা সরবরাহ করে তারা। একই সঙ্গে সৌরবিদ্যুৎ ও পাট খাতে পান্না গ্রুপের ব্যবসা রয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানের একটি অটোমেটিক ব্যাটারি কারখানা নির্মাণ করছে পান্না গ্রুপ। এখানে মাসে প্রায় দুই লাখ ব্যাটারি তৈরি হবে। এজন্য জার্মানি থেকে প্রধান যন্ত্রাংশগুলো আনা হয়েছে। কোরিয়া ও তাইওয়ান থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তিগত সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। এখানে প্রায় ১৬০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হবে। সাধারণ ব্যাটারি কারখানার তুলনায় এখানে শ্রমিক তুলনামূলক কম লাগবে। অনেক রোবট এখানে কাজ করবে। কারখানাটি থেকে উৎপাদিত পণ্য বিশ্বের প্রায় ৬২ দেশে রফতানি করা হবে।
দেশ-বিদেশের অনেক পুরস্কারে পূর্ণ পান্না গ্রুপের ঝুলি। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জার্মানির বিআইডি অ্যাওয়ার্ড-২০১২।
‘আমি যে ব্যবসা শুরু করেছিলাম, ধৈর্য ধরে সেটিতেই আছি। ফলশ্রুতিতে এ পর্যায়ে আসা সম্ভব হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি সামর্থ্যবান যে কোনো উদ্যোক্তার নিজ এলাকার মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য এলাকাতেই কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা উচিত। সেক্ষেত্রে উদ্যোক্তার সামাজিক দায়বদ্ধতা যেমন পালন হবে, তেমনি মানুষের শহরমুখী হওয়ার প্রবণতাও কমবে। এতে গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে কর্মচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হবে, দেশও এগিয়ে যাবে’
মো. লোকমান হোসেন
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
রতন কুমার দাস