কেমিক্যাল মিশ্রিত প্যাকেটজাত মুড়ির ভিড়ে আসল মুড়ির স্বাদ পাওয়া অনেকটাই কঠিন। মুড়ির আসল স্বাদ পেতে পাবনার ‘মুড়ি গ্রামের’ হাতে তৈরি মুড়ি খেতে পারেন। তুলনাহীন এই মুড়ির কদর বাড়ছে। কোনো কেমিক্যাল ছাড়া হাতে তৈরি এই মুড়ি দেবে আসল স্বাদ। বর্তমানে মুড়ি তৈরির পেছনে ব্যস্ত সময় পার করছেন পাবনার মুড়ি গ্রামের নারী-পুরুষ। কাকডাকা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলছে তাদের এ ব্যস্ততা। কয়েক পুরুষ ধরে মুড়ি তৈরির কাজে নিয়োজিত গ্রামের অধিকাংশ মানুষ। তাদের দীর্ঘদিনের শ্রম-সাধনায় মুড়ি তৈরির এ গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে শিল্পের রূপ নিয়েছে।
পাবনা শহর থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার মালঞ্চি ইউনিয়নের ছোট্ট গ্রাম মাহমুদপুরকে পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের মানুষ চেনেন ‘মুড়ি গ্রাম’ হিসেবে। কয়েক যুগ ধরে বংশপরম্পরায় এ গ্রামের মানুষদের জীবিকার প্রধান অবলম্বন মুড়ি তৈরি ও বিপণন। সময়ের সঙ্গে এখানকার মুড়ির সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে ঢাকা, টাঙ্গাইল, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। সারা বছর ধরে মুড়ি তৈরি করলেও রোজার মাসে তাদের ব্যস্ততা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। স্বাধীনতার আগে এ গ্রামে প্রথম মুড়ি তৈরি শুরু করেন বয়োবৃদ্ধ হাসান আলী। সে থেকেই শুরু; এখনও সবাই বাপ-দাদার পেশা হিসেবে মুড়ি উৎপাদনকে ধরে রেখেছেন।
কালের আবর্তে মুড়ি তৈরি মাহমুদপুরের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে পার্শ্ববর্তী
শ্যামপুর, বিলকোলা, গোপীনাথপুর,
ভবানীপুর, রাঘবপুরসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে। সম্প্রতি এক ভোরে মাহমুদপুর ও পার্শ্ববর্তী শ্যামপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় সব বাড়িতে চলছে মুড়ি তৈরির কাজ। শ্যামপুরের মোহম্মদ আলী জানান, শৈশব থেকেই তিনি মুড়ি তৈরি ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেন, গ্রামের পুরুষরা হাট থেকে ধান কেনা, ধান ভাঙানো ও উৎপাদিত মুড়ি বাজারে বিক্রি করেন। নারীরা ধান সেদ্ধ, শুকানো, মুড়ি তৈরিসহ নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। মোহম্মদ আলী আরও জানান, বছর ধরে এ পেশায় থাকলেও তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। একই গ্রামের শরিফা খাতুনকে দেখা গেল গনগনে চুলার পাশে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে মুড়ি তৈরি করতে। আলাপকালে মুড়ি তৈরির কাজে নিয়োজিত হাসিনা বেগম, মীরা ও সুফিয়া খাতুন জানান, স্বর্ণা, বিআর-১১, বিআর-২৯, আউশ ধান থেকে তারা মুড়ি তৈরি করেন। এর মধ্যে আউশ ধানের মুড়ির স্বাদ বেশি হওয়ায় বাজারে তার চাহিদা সবচেয়ে বেশি।
মুড়ি গ্রামের বৈশিষ্ট্য হলো গ্রামের কোথাও ইউরিয়া বা অন্য কোনো কেমিক্যাল মিশিয়ে মুড়ি তৈরি করা হয় না। তারা বালি আর লবণ-পানির মিশ্রণ দিয়ে নিজের হাতে মুড়ি তৈরি করেন। তারা জানান, এক মণ ধান থেকে ২২ থেকে ২৪ কেজি মুড়ি তৈরি করা হয়। সব খরচ বাদ দিয়ে এক মণ ধানের মুড়ি বিক্রি করে তাদের হাতে লাভ থাকে দেড়শ থেকে দুইশ টাকার মতো। অনেকে আবার সে টাকাও ধরে রাখতে পারেন না। কারণ হিসেবে মুড়িশ্রমিক আবু শামা জানান, নিজের পুঁজি না থাকায় অনেক মুড়িশ্রমিক বিভিন্ন এনজিও থেকে, অনেকে দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে বাপ-দাদার এই পেশা টিকিয়ে রেখেছেন। উৎপাদিত মুড়ি বিক্রি করে লাভের টাকা থেকে ঋণের সুদ পরিশোধ করার পর হাতে আর তেমন টাকা থাকে না। পাশাপাশি সাম্প্রতিককালে বাজারে প্যাকেটজাত মুড়ির সরবরাহ বেশি হওয়ায় মুড়ির চাহিদায় ঘাটতি পড়েছে বলেও তারা জানান।
কয়েকজন মুড়িশ্রমিক অভিযোগ করে বলেন, প্যাকেটজাত মুড়িতে ইউরিয়া মেশানোসহ বিভিন্ন কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। এসব মুড়ি শরীরের জন্য ক্ষতিকর হলেও দেখতে ভালো ও আকারে বড় হওয়ায় মানুষ সেগুলো অধিক হারে কিনছে। বর্তমানে মাহমুদপুরে উৎপাদিত মুড়ি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে।
পাবনা বিসিক শিল্পনগরীর উপমহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী জিতেন্দ্রনাথ পাল বলেন, মাহমুদপুর গ্রামের মুড়ি তৈরির বিষয়টি আমাদের তথ্যে রয়েছে। তারা কেমিক্যালমুক্ত হাতে তৈরি মুড়ি তৈরি করেÑএটা খুবই ভালো খবর। এসব কুটিরশিল্পের সঙ্গে জড়িতদের সরকারিভাবে সহযোগিতা করার পরিকল্পনা আমাদের আছে। তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সহজ শর্তে কিছু ঋণসহ অন্যান্য সুবিধা পাবেন।
সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে
সহযোগিতা ও মুড়িশ্রমিকদের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা হলে একদিকে ক্ষুদ্র এ শিল্পের যেমন দ্রুত বিকাশ ঘটবে, অপরদিকে এ পেশার সঙ্গে জড়িত কয়েকটি গ্রামের মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটবে এমনটাই প্রত্যাশা এলাকাবাসীর।
শাহীন রহমান