ইসমাইল আলী:আদানির বিদ্যুৎ পরীক্ষামূলক আসা শুরু হয় গত ৮ মার্চ। ৬ এপ্রিল থেকে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করে ভারতের এ কোম্পানিটি। তবে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরুর আগেই আদানির বিদ্যুতের দাম নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। কারণ এ কেন্দ্রটির জন্য কয়লার দাম ধরা হয়েছিল বাংলাদেশের পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে ৬৩ শতাংশ বেশি। এতে আদানির বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) গচ্চা যেত মাসে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা।
সে সময় বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি সংশোধনে আদানিকে চিঠি দেয় সংস্থাটি। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদানি ও পিডিবির মাঝে কয়লার দাম নির্ধারণ নিয়ে দরকষাকষি শুরু হয়। অবশেষে কয়লার দাম নির্ধারণের বিষয়টি চূড়ান্ত করেছে আদানি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের আমদানিনির্ভর কয়লা দিয়ে পরিচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের (পায়রা ও রামপাল) সর্বোচ্চ ব্যয়ের চেয়ে আদানির জ্বালানি দাম দশমিক শূন্য এক সেন্ট (০.০১) কম রাখা হবে বলে জানিয়েছে কোম্পানিটি।
গত ১ জুলাই পিডিবি চেয়ারম্যানকে এক চিঠিতে এ তথ্য জানায় আদানি। বিষয়টি নিজেদের বিজয় হিসেবে দেখছেন পিডিবির কর্মকর্তারা। তারা জানান, পূর্ণ সক্ষমতায় বিদ্যুৎ কিনলে আদানির কেন্দ্রের জ্বালানি বিল বাবদ পায়রার চেয়ে মাসে ১ কোটি টাকা খরচ কম হবে। আর আদানির বিদ্যুৎ কিনতে বর্তমানে খরচ পড়বে সর্বোচ্চ ১১ টাকা। গত ডিসেম্বরেও পিডিবি এ ব্যয় প্রাক্কলন করেছিল ২০ টাকার কাছাকাছি।
প্রসঙ্গত, আদানির বিদ্যুতের উচ্চ দাম নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে শেয়ার বিজ। এর মধ্যে গত ২৪ জানুয়ারি ‘কয়লার দাম ধরা হয়েছে ৪২% বেশি: আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রে মাসে গচ্চা যাবে ৭০০ কোটি টাকা!’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে আদানিসহ দেশের পাঁচটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয়ের তুলনামূলক বিবরণ তুলে ধরা হয়। ৩ ফেব্রুয়ারি ছাপা হয় ‘চুক্তি সংশোধন চেয়ে চিঠি: কয়লার দাম না কমালে আদানির বিদ্যুৎ কিনবে না বাংলাদেশ!’। এছাড়া আরও বেশকিছু প্রতিবেদন ছাপা হয় আদানির বিদ্যুৎ কেনা নিয়ে।
পিডিবির চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে ঢাকা আসে আদানির প্রতিনিধিদল। তখন তারা কয়লার দাম কম রাখার মৌখিক প্রতিশ্রুতি দিয়ে যায়। এরপরও একাধিকবার আলোচনা হয় পিডিবি ও আদানির মধ্যে। অবশেষে আদানি রাজি হয়েছে জ্বালানি তথা কয়লার দাম কম রাখতে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের আমদানিনির্ভর কয়লা দিয়ে পরিচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে আদানির জ্বালানি ব্যয় দশমিক শূন্য এক সেন্ট (০.০১) কম রাখা হবে। প্রতি মাসে এ দাম সমন্বয় করা হবে বলেও চিঠিতে জানানো হয়।
জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিডিবির একাধিক সদস্য জানান, আদানির বিদ্যুতের দাম নিয়ে পিডিবির অনড় অবস্থানের কারণে শেষ পর্যন্ত
কয়লার মূল্য কম রাখতে রাজি হয়েছে। এতে মাসে পিডিবির অন্তত ৭০০ কোটি টাকা গচ্চা যাওয়া থেকে সাশ্রয় হবে।
সূত্রমতে, গত ডিসেম্বরে পিডিবি দেশের আমদানিনির্ভর কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর খরচ হিসাব করে। এতে দেখানো হয়, বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার (৮৫ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টর) হলে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি ব্যয় পড়বে ১৩ টাকা ৮৯ পয়সা। আদানির কেন্দ্রে এ ব্যয় ১৯ টাকা ৬২ পয়সা। অর্থাৎ পায়রার তুলনায় আদানির জ্বালানি ব্যয় বেশি পড়ত ৫ টাকা ৭৩ পয়সা বা ৪১ দশমিক ২৫ শতাংশ।
যদিও বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম অনেক কমে গেছে। এতে পায়রায় জ্বালানি ব্যয় পড়ছে প্রায় সাড়ে পাঁচ টাকার মতো। আদানির কেন্দ্রে পায়রার চেয়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জ্বালানি ব্যয় দশমিক শূন্য এক সেন্ট বা ১.০৯ পয়সা কম পড়বে। আর আদানির কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ পাঁচ টাকার মতো। রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় মিলিয়ে বর্তমানে আদানির প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনতে খরচ পড়বে প্রায় সাড়ে ১০ থেকে ১১ টাকার মধ্যে।
উল্লেখ্য, ভারতের ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় নির্মিত আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সক্ষমতা এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। তবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী কেন্দ্রটি থেকে এক হাজার ৪৫৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরুর পর থেকে নিয়মিত ৭০০-৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে আদানি। চলতি মাসে দ্বিতীয় ইউনিটটি থেকে বিদ্যুৎ আসার কথা রয়েছে।
পরীক্ষামূলক উৎপাদনের সময়ে পিডিবির কাছে প্রায় সাড়ে ১৫ কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে ভারতের এ কোম্পানিটি। এজন্য আদানি বিল জমা দেয় প্রায় সাড়ে ১৭ মিলিয়ন ডলার বা ১৮৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি ইউনিটের বিদ্যুতের দাম পড়ে ১২ টাকার মতো (১১ দশমিক ৮৮ সেন্ট)। যদিও এ বিলের মধ্যে শুধুই কয়লার দাম ছিল। ক্যাপাসিটি চার্জ পরীক্ষামূলক সময়ের জন্য ধরা হয়নি।