এনামুল হক নাবিদ, আনোয়ারা (চট্টগ্রাম): দক্ষিণ চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক শিল্পাঞ্চল হিসেবে পরিচিত আনোয়ারা উপজেলার বঙ্গোপসাগরের কূলে পারকিসৈকত এলাকায় বিনির্মাণ হচ্ছে বিশ্বমানের পর্যটন কমপ্লেক্স। এটি কারও কাছে মিনি কক্সবাজার, আবার কারও কাছে প্রকৃতির রূপসী কন্যা নামে পরিচিত। উপজেলার চৌমুহনী বাজার থেকে পশ্চিমে সিইউএফএল রোড ধরে লাল পাহাড়ের নোঙর পথ ধরে উপজেলার ২নং বারশত এলাকায় পারকি সমুদ্র সৈকত। সৈকতজুড়ে বিশাল আকৃতির ঝাউবাগান গড়ে ওঠায় ভ্রমণপিপাসুদের কাছে ঝাউ বাগান নামেও পরিচিত এ সৈকত।
কর্ণফুলী নদীর মোহনায় উপজেলার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের কূল ঘেঁষে অবস্থিত পারকি সমুদ্র সৈকতের জনপ্রিয়তা দিন দিন দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতিদিন হাজারো পর্যটক দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে ছুটে আসেন সৈকতের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখার জন্য। সৈকতের আশাপাশে ভালো হোটেল, মোটেল না থাকায় এখানে আসা পর্যটকদের সন্ধ্যা নামার আগে গন্তব্য ফিরে যেতে হয়। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য ২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে জনপ্রিয় এ সমুদ্র সৈকতকে অত্যাধুনিক পর্যটন স্পট বানাতে ৭১ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে আধুনিক পর্যটন কমপ্লেক্স। পুরো সৈকতের চেহারা বদলে দিচ্ছে সরকারের এ মেগা প্রকল্প। পারকিতে এ পর্যটন কমপ্লেক্স নির্মাণ হলে পারকি হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোন।
কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে বহুল প্রত্যাশিত ও স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ এখন দৃশ্যমান। টানেলের মাধ্যমে কর্ণফুলীর দুইপাড় সংযুক্ত হচ্ছে। এ পাড়ের আনোয়ারা পয়েন্টের টানেলের টিউবের মুখ বের হয়েছে পারকি সিইউএফএল এলাকায়। চট্টগ্রাম শহর থেকে পারকি সৈকতের দীর্ঘ ৩৫ কিলোমিটার হলেও টানেলের আনোয়ারা পয়েন্ট থেকে পারকির দূরত্ব হবে মাত্র আট কিলোমিটার। টানেল ব্যবহার করে সহজে পর্যটকরা ১৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যেতে পারবেন পারকি সমুদ্রসৈকতে। চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড হয়ে টানেলের ভেতর দিয়ে যানবাহন উঠবে কক্সবাজার মহাসড়কে। এ লক্ষ্যে প্রস্তুত হচ্ছে আনোয়ারা থেকে শিকলবাহা পর্যন্ত প্রায় ১১ কিলোমিটার ছয় লেনের সড়ক। ফলে আনোয়ারার সঙ্গে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও সহজ হবে। টানেল ঘিরে শিল্পকারখানা ও আবাসনের পাশাপাশি খুলবে পর্যটন শিল্পের নতুন দুুয়ার। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদচারণে মুখর হবে পারকি। হবে কর্মসংস্থান, বাড়বে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন। ফলে পর্যটন খাত থেকে সরকারের আয় বাড়বে, যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এমনটাই মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পারকি সমুদ্র সৈকতে মহাপরিকল্পনা বাস্তায়নের কাজ চলছে। পর্যটন করপোরেশনের উদ্যোগে ১৩ দশমিক ৩৬ একর জমিতে ৭১ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে বিশ্বমানের পর্যটন কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হচ্ছে। ২০১৮ সালের নভেম্বরে শুরু হয়েছিল এ প্রকল্পের কাজ। প্রকল্পের ব্যয় ছিল ৬২ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ছিল দুই বছর। ২০২০ সালের নভেম্বরে মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। দ্বিতীয় দফায় এর মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। বর্তমানে এ প্রকল্পের বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনের মূল কাজ ৪০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
প্রকল্পের মধ্যে মোট ১৭টি স্থাপনা নির্মাণ করা হবে। ১৪টি আধুনিক কটেজ রয়েছে। এর মধ্যে চারটি ডবল ডুপ্লেক্স কটেজ ও ১০টি সিঙ্গেল কটেজ। চতুর্থ তলাবিশিষ্ট একটি মাল্টিপারপাস ভবন। এর গ্রাউন্ড ফ্লোরে থাকবে পর্যটন অফিস, দ্বিতীয় তলায় থাকবে দুটি দোকান, একটি রেস্টুরেন্ট, তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় থাকবে দুটি বার, একটি ২৫০ আসনের কনভেনশন হলো। তৃতীয় তলাবিশিষ্ট একটি সার্ভিস ব্লক, যেখানে ছাত্রছাত্রীদের থাকার বিশেষ ব্যবস্থাসহ পর্যটকদের জন্য সিঙ্গেল ব্যাচেলর সার্ভিস রুম ৩৫টি, কমপ্লেক্স সার্ভিস স্টাফদের জন্য ৪৪টি রুম রয়েছে। একটি ওয়াশরুম ব্লক, যেখানে নারী-পুরুষদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়া একটি লেক, একটি ঝুলন্ত ব্রিজ, দুটি পিকনিক শেড, কুকিং শেড। একটি খেলার মাঠ, যার মধ্যে ভলিবল, টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন খেলার ব্যবস্থা থাকবে এবং গাড়ি পার্কিংয়ের সুবিধাও রাখা হচ্ছে। প্রত্যেকটি ভবনের সামনে সাজানো বাগান।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আনোয়ারা-কর্ণফুলীর সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর প্রস্তাবে ৯ বছর আগে চট্টগ্রামের একটি জনসভায় পারকি সমুদ্র সৈকতকে আধুনিক পর্যটন শিল্প এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে অনুযায়ী পারকি সৈকতে শুরু হয়েছে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ।
প্রকল্পের কাজের বিষয়ে জানতে চাইলে পর্যটন করপোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী অসীম শীল বলেন, প্রকল্পের কাজের মেয়া বাড়ানো হয়েছে। কভিডের কারণে নির্মাণকাজ একটু ধীরগতিতে হয়েছিল। আশা করি, ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের মূল কাজ শেষ হবে।
আনোয়ারা উপজেলা চেয়ারম্যান তৌহিদুল হক চৌধুরী বলেন, আনোয়ারা একটি শিল্পাঞ্চল। বঙ্গবন্ধু টানেল বাস্তবায়নে আনোয়ারা পরিণত হতে যাচ্ছে বিশ্বমানের পর্যটন স্পটে। বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে পারকি সমুদ্র সৈকত একটি প্রাকৃতিক সম্পদ। শিল্প এলাকায় এমন একটি প্রাকতিক সম্পদ বৈরী আবহাওয়া মোকাবিলায় দারুণ কাজ করে। তার জন্য সরকারের মেগা প্রকল্পের পাশাপাশি আমরা উপজেলা পরিষদও পারকি সৌন্দর্য বর্ধনে কাজ করে যাচ্ছি।