শেয়ার বিজ ডেস্ক: বাংলাদেশ ও ভারত বর্তমানে সর্বকালের সেরা সম্পর্ক উপভোগ করছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উভয় দেশের ব্যবসায়ীদের নিজ নিজ জনগণের পারস্পরিক স্বার্থে কাজ করে এ অঞ্চলকে আরও সমৃদ্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি আপনাদের সবাইকে প্ল্যাটফর্মটির সর্বোত্তম ব্যবহার করতে এবং আমাদের জনগণের পারস্পরিক বৃহত্তর স্বার্থে উভয় দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার অনুরোধ করছি। এর মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশ ও এ অঞ্চলকে আরও সমৃদ্ধ এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত করতে পারব। প্রধানমন্ত্রী গতকাল এখানে আইসিটি মৌর্য হোটেলের কামাল মহল হলে ভারত-বাংলাদেশ বিজনেস ফোরামের (আইবিবিএফ) উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে এ কথা বলেন। সূত্র: বাসস।
আইবিবিএফের প্ল্যাটফর্মের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারত সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক উপভোগ করছে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আপনাদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সুনিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা আপনাদের প্রচেষ্টা সহজ করার জন্য সব ধরনের সহায়তা প্রদানে প্রস্তুত রয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী ভারতের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কগুলোয় বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে বলেন, বেশ কয়েকটি হাইটেক পার্ক প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী উদ্যোগের জন্যও প্রস্তুত রয়েছে। মোংলা, ভেড়ামারা ও মিরসরাইয়ে ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য তিনটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রস্তুত করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এ তিনটি ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চলে ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের পর্যাপ্ত বিনিয়োগ আমাদের রফতানিযোগ্য খাতকে আরও প্রশস্ত করতে সহায়তা করবে।
আমরা সারা দেশে ১০০ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছি; এর মধ্যে প্রায় ১২টি তৈরি হয়ে গেছে, যেখানে চারটি অঞ্চল তিন দেশের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছেÑযোগ করেন তিনি। এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে বাংলাদেশের গড়ে ওঠা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশের কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান দেশটিকে এ অঞ্চলের অর্থনীতির কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে ব্যাপক সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। পশ্চিমে ভারত, উত্তরে চীন ও পূর্বদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। বাংলাদেশ চার বিলিয়ন মানুষের বাজারের মাঝামাঝি রয়েছে। বৈশ্বিক সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবৃদ্ধির উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সালে আমাদের সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বাংলাদেশে বৈশ্বিক এফডিআই’র ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রতি-ক্রমবর্ধমান আস্থারই প্রতিফলন।
সংসদের প্রাসঙ্গিক আইন ও দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তি দ্বারা বিদেশি বিনিয়োগকে সুরক্ষা প্রদান করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা একসঙ্গে আরও বাণিজ্য ও বিনিয়োগ দেখতে চাই, যেখানে ভারতীয় বড় বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে শিল্প স্থাপন করতে এবং আমাদের মধ্যে বিদ্যমান উন্নত যোগাযোগব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে উত্তর ভারতের রাজ্যগুলো ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোয় পণ্য রফতানি করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমরা জানি, বিশ্বের বেশিরভাগ বর্ধিষ্ণু অর্থনীতির দেশ প্রতিবেশী দেশগুলোতেই তাদের প্রাথমিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের প্রকল্প গ্রহণ করেছে। একইভাবে ভারতীয় ব্যবসায়ী নেতারা আমাদের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে আরও এগিয়ে নিতে খুব বড় ভূমিকা পালন করেতে পারেন এবং ঐক্যবদ্ধভাবে আমরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা বা সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হব। আর এভাবেই আমরা আমাদের শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারি।
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে ভারতীয় ব্যবসায়ী নেতাদের দেশে সবচেয়ে উদার বিনিয়োগনীতি বলবৎ থাকার বিষয়টি পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে উদার বিনিয়োগের পরিবেশ বিরাজ করছে। যার মধ্যে রয়েছে বৈদেশিক বিনিয়োগের আইনি সুরক্ষা, উদার রাজস্ব ব্যবস্থা, মেশিনপত্র আমদানির ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড়, আনরেসট্রিকটেড এক্সিট পলিসি, সম্পূর্ণ বিনিয়োগ ও পুঁজি নিয়ে চলে যাওয়ার সুবিধাসহ নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, সংসদের প্রাসঙ্গিক আইন ও দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তির দ্বারা বিদেশি বিনিয়োগকে সুরক্ষা প্রদান করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের বিশাল জনসংখ্যা, যাদের বেশিরভাগের বয়স ২৫ বছরের কম, যারা অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক মজুরিতে নিযুক্ত হতে প্রস্তুত রয়েছেন। বাংলাদেশের সম্ভাবনার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, দ্রুত নগরায়ণের ফলে বিদ্যুৎ চাহিদা বৃদ্ধি এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশে বিনিয়োগকারীদের বাজার সম্ভাবনার দিকেই ইঙ্গিত করে।
সন্ত্রাস ও দুর্নীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ১৬২ মিলিয়ন জনসংখ্যা সমন্বিত একটি প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। দুদেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিগত বছরগুলোয় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি আরও বলেন, দুদেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে আট দশমিক আট বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করে ভারত এবং বাংলাদেশ দেশটির আটতম বৃহত্তম রফতানি গন্তব্য। ভারতে আমাদের রফতানিও গত বছর প্রথমবারের মতো এক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
অনুষ্ঠানে ‘প্রতিশ্রুতিশীল বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি ভিডিও উপস্থাপনা পরিবেশিত হয়। অনুষ্ঠানে ভারতের শিল্প ও রেলমন্ত্রী পীযূষ গয়াল বলেন, বাংলাদেশ ও ভারত এখন সবচেয়ে দৃঢ় সম্পর্ক উপভোগ করছে। তিনি এ সুবিধা গ্রহণ করে দুদেশের মানুষের উন্নতির জন্য অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য খাতকে আরও নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিতে উভয় দেশের ব্যবসায়ীর প্রতি আহ্বান জানান। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক এযাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতার সম্পর্ক শুরু হয়েছে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে। ১৯৭১-এর চেতনা সব সময় আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা দিয়ে আসছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারত সরকার ও দেশটির জনগণের কাছ থেকে যে সমর্থন এবং সহযোগিতা বাংলাদেশ পেয়েছে প্রধানমন্ত্রী শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তা স্মরণ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভূরাজনৈতিক রূপান্তর ও চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও পারস্পরিক স্বার্থ এবং অভিন্ন ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার নীতির ওপর ভিত্তি করে আমরা আমাদের সম্পর্ক জোরদার করতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের সহযোগিতা নিরাপত্তা, জ্বালানি, যোগাযোগ, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, প্রতিরক্ষা, সংস্কৃতি এবং জনগণের মধ্যে সম্পর্ক ও যোগাযোগসহ সব ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়েছে।
১০ বছরে বাংলাদেশের ব্যাপক অর্থনৈতিক অগ্রগতির কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা গত এক দশকে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক উন্নয়নে সক্ষম হয়েছি, যা উন্নয়নের মডেল হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছে। বাংলাদেশকে বিশ্বের দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলোর অন্যতম দেশ হিসেবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের তৈরি পোশাক রফতানিতে দ্বিতীয়, অভ্যন্তরীণ মৎস্য উৎপাদনে তৃতীয়, মিঠাপানির মৎস্য উৎপাদনে চতুর্থ, চাল উৎপাদনে চতুর্থ এবং রেমিট্যান্স অর্জনে অষ্টম বৃহত্তম অবস্থানে রয়েছে।
এক দশকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাফল্য তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, গত ১০ বছরে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি গড়ে সাত শতাংশ থেকে গত বছর ৮.১ শতাংশে পৌঁছেছে এবং আশা করা হচ্ছে চলতি অর্থবছরে তা ৮.৩ শতাংশে দাঁড়াবে। তিনি বলেন, মুদ্রাস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৫.৪ শতাংশ, মাথাপিছু আয় ২০০৬ সালের ৫৪৩ ডলার থেকে ৩.৫ গুণ বেড়ে ২০১৯ সালে প্রায় ২০০০ ডলারে দাঁড়িয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ বিলিয়ন ডলার, রফতানি ২০০৫-০৬ সালের চেয়ে তিনগুণ বেড়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৪০.৫৩ বিলিয়ন ডলারে।
প্রাইসওয়াটারহাউসকুপার্সের পরিসংখ্যান তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৯তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। বিশ্বব্যাংক তাদের সাম্প্রতিক প্রকাশনায় বাংলাদেশকে বিশ্বের দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির পাঁচ দেশের অন্তর্ভুক্ত করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এইচএসবিসি ২০১৮ সালে তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশ ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের ২৬তম বৃহত্তম অর্থনীতি ও দ্রুত বিকাশমান তিনটি অর্থনীতির দেশের একটি হবে।
এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের আউটলুক-২০১৯ রিপোর্টের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশ হবে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতি। এ অর্জন সম্ভব হয়েছে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, সুশাসন, অব্যাহত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং জোরদার সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতির সুবাদে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এসব অর্জন বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন পূরণের সাফল্য এনে দিয়েছে। যদি এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকে, যদি আমাদের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে পারি, তবে আশা করি ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করা সম্ভব হবে। তিনি দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও জোরদারে রাজনৈতিক কূটনীতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক কূটনীতির ওপরও গুরুত্বারোপ করেন।

Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 1:41 am
পারস্পরিক স্বার্থে কাজ করতে ব্যবসায়ীদের আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর
দিনের খবর,প্রথম পাতা ♦ প্রকাশ: