পারিবারিক অসচেতনতায় শিশু অসামাজিক হয়ে ওঠে

মাসুমা রুমা: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টটল তার ‘দ্য পলিটিকস’ গ্রন্থে বলেছেন, মানুষ স্বভাবতই সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব। মানুষ সমাজে জন্ম গ্রহণ করে এবং লালিত-পালিত হয়। যে মানুষ সমাজে সভ্য নয়, সে হয় দেবতা, না হয় পশু। সামাজিকীকরণ এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে মানুষ সমাজের সঙ্গে পরিচিত হয়, সামাজিক রীতিনীতি, মূল্যবোধ ও ভাবধারা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে। এভাবে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া চলতে থাকে মানুষের। এ প্রক্রিয়া শুরু হয় মূলত ছোটবেলাতেই। এ বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতন থাকা প্রয়োজন, যাতে করে শিশুর প্রকৃত সমাজিকীকরণ হয়। সামাজিকীকরণ শিশুদের সামাজিক আচরণ শিক্ষা দেয়। তারা সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল হয়ে ওঠে, যা পরবর্তীকালে ব্যক্তি হিসেবে তার মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগ্রত করে এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার ধারণা জন্ম দেয়। দেশগঠন, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সব ধরনের সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণ এবং রাজনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে শিশুদের সামাজিকীকরণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

আজকের শিশুই আগামীর ভবিষ্যৎ। তাই শিশুর সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার ওপর জাতির ভাগ্য অনেকাংশই নির্ভরশীল। পরিবারের সুস্পষ্ট ও সঠিক দিক নির্দেশনাতেই শিশুর সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। কাজেই আমাদের ছোটখাটো ত্রুটি গড়ে ওঠার পেছনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের পরিবারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব থাকে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, যেসব পরিবারে ঝগড়াঝাঁটি, হানাহানি, বিদ্বেষ, সহিংসতা এসব বেশি থাকে, সেসব পরিবারের শিশুদের বিকাশ সঠিকভাবে হয় না। আর এসব পরিবারের শিশুদের সামাজিক মূল্যবোধের মতো তাৎপর্যপূর্ণ গুণাবলি গড়ে ওঠে না। আর তারাই পরবর্তী সময়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা ও হানাহানির সৃষ্টি করে। তাই আমাদের মূল্যবোধ গড়ে ওঠার পেছনেও আমাদের বাবা-মায়ের ভূমিকা রয়েছে।

পরিবার সামাজিকীকরণের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। শিশুর জীবনের ভালো ও খারাপ অভ্যাস পরিবারের সামাজিকীকরণের ফল। পরিবারের মধ্যেই শিশুর ভেতর সামাজিক নীতিবোধ, নাগরিক চেতনা, সহযোগিতা, সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ববোধ, আত্মত্যাগ ও ভালোবাসা জš§ নেয়। পারিবারিক বিশৃঙ্খলা, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ, ছাড়াছাড়ি, ভিন্ন গৃহে বসবাস, বাবা কিংবা মা অথবা বাবা-মা উভয়ের মৃত্যু শিশুর সুষ্ঠু সামাজিকীকরণে বাধার সৃষ্টি করে। এসব পরিবারে শিশুর সুষ্ঠু সামাজিকীকরণ হয় না। সুতরাং শিশুর সামাজিকীকরণে পরিবারের সদস্যদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর যথাযথ সামাজিকীকরণ নিশ্চিত করতে শিশুকাল থেকেই অভিভাবক ও পরিবারের সদস্যদের সচেতন থাকা বাঞ্ছনীয়।

পাশ্চাত্য সংস্কৃতি শিশুর সামাজিকীকরণে বড় বাধা। বিনোদনের কোনো মাধ্যমই এখন পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবমুক্ত নয়, যার দরুণ শিশুরা শৈশব থেকেই ভিনদেশের সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠছে, ভুলে যাচ্ছে নিজস্ব সংস্কৃতি। আমরা সবাই জানি, যার যার নিজস্ব সংস্কৃতি মানুষকে একজন প্রকৃত আর মানবিক মানুষ রূপে গড়ে তোলে। বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে আমরা দেখব, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির কুপ্রভাব সম্পর্কে অধিকাংশ পরিবারই নীরব ভূমিকা পালন করছে। তারা এটাকে সমস্যা হিসেবেই গণ্য করছে না। অথচ এই পাশ্চাত্য সংস্কৃতি শিশুর সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করছে এবং উইপোকার মতো শিশুর ভেতরটাকে ফাঁপা করে দিচ্ছে। কাজেই শিশুর সামাজিকীকরণে পারিবারিক সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।

যৌথ পরিবার শিশুর সামাজিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি যৌথ পরিবারে নানা বয়সি মানুষের বসবাস। বলতে গেলে নানামুখী অভিজ্ঞতার বাতিঘর হলো যৌথ পরিবার। ফলে একটি শিশু খুব সহজেই জীবন-বাস্তবতার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে। পরিবারেই তারা অদূর ভবিষ্যতের জীবনসংগ্রামের জন্য লড়াইয়ের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। এসব পরিবারের শিশুরা ক্রমাগত বাস্তববাদী হয়ে ওঠে। তাদের মনোবল প্রবল হয়ে ওঠে। হতাশা তাদের গ্রাস করতে সক্ষম হয় না। তাদের মানসিক বৃদ্ধি বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সঠিকমাত্রায় হয়। পরিতাপের বিষয়, বর্তমান সময়ে যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার প্রথা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। একক পরিবারে অভিভাবকেরা খুব কমই উপলব্ধি করেন, শিশুর সামাজিকীকরণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে। ফলে এসব শিশু ভবিষ্যতের জন্য নিজেদের তৈরি করতে পারে না সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে। ফলে তাদের সামাজিক হয়ে ওঠার পেছনে কাজ করে অভিভাবক ও পরিবারের সদস্যদের অসচেতনতা।

সাম্প্রতিক সময়ের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমাদের সবার জীবনের মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। বিশেষত আগামী দিনের নাগরিক যারা, সেই কোমলমতি শিশু-কিশোরদের ওপর এই পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি  প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। শিশুদের ওপর তাদের পরিবারের প্রভাব সর্বদাই। সর্বাগ্রে পরিবার মানুষ হিসেবে তাদের চরিত্র গঠনে ভূমিকা রাখে, কোনো শিশুকে সমাজের কাছে পরিচিত করে তোলে। সুতরাং বাবা-মা ও অভিভাবকদের মনে রাখা উচিত, পরিবার থেকে শিশু যে শিক্ষা পায়, তা তাকে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করে। পরিবারের শিক্ষা যদি ভঙ্গুর হয়, তাহলে শিশুরা পরবর্তী জীবনে নানা বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হয়। কাজেই শিশুর প্রকৃত ও সঠিক সামাজিকীকরণ নিশ্চিত করতে পারিবারিক সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।

পিআইডি নিবন্ধ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০