Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 2:16 pm

পারিবারিক সহিংসতা: আইন ও  আজকের বাংলাদেশ

মো. মোজাম্মেল হক: বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদে সুযোগের সমতার কথা বলা হয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনীতে ১৯ এর (৩) অনুচ্ছেদে আরও বলা আছে, ‘জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন। ইহা ছাড়াও জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সাধন ১৯৭৯ ও শিশু অধিকার সনদ ১৯৮৯ এর স্বাক্ষরকারী রাষ্ট  হিসেবে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে উক্ত রূপ বিধান থাকার কারণে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ তথা পারিবারিক সহিংসতা থেকে নারী ও শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীতা দেখা দেয় এবং সেই প্রণীত আইনই হইতেছে পারিবারিক সুরক্ষা আইন।’

পারিবারিক সহিংসতা বলিতে পারিবারিক সম্পর্ক রহিয়াছে এমন কোনো ব্যক্তি কর্তৃক পরিবারের অপর কোনো নারী বা শিশু সদস্যের উপর শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন অথবা আর্থিক ক্ষতিকে বুঝাইবে। (ক) শারীরিক নির্যাতন অর্থ এমন কোনো কাজ বা আচরণ করা, যাহা দ্বারা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির জীবন, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বা শরীরের কোনো অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বা ক্ষতিগ্রস্ত হইবার সম্ভাবনা থাকে এবং সংক্ষুব্ধকে অপরাধমূলক কাজ করিতে বাধ্য করা বা প্ররোচনা প্রদান করা বা বল প্রযোগও ইহার অন্তর্ভুক্ত হইবে; (খ) মানসিক নির্যাতন অর্থ নি¤œলিখিত বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত হইবে, যথা (অ) মৌখিক নির্যাতন, অপমান, অবজ্ঞা, ভীতি প্রদর্শন বা এমন কোনো উক্তি করা যাহা দ্বারা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়; (আ) হয়রানি বা (ই) ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ অর্থাৎ স্বাভাবিক চলাচল বা ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা মতামত প্রকাশের উপর হস্তক্ষেপ, (গ) যৌন নির্যাতন অর্থ যৌন প্রকৃতির এমন আচারণও অন্তর্ভুক্ত হইবে, (ঘ) আর্থিক ক্ষতি বলিতে নি¤œবর্ণিত বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত হইবে, যথা (অ) আইন বা প্রথা অনুসারে বা কোনো আদালত বা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত আদেশ অনুযায়ী সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি যে সকল আর্থিক সুযোগ-সুবিধা, সম্পদ বা সম্পত্তি লাভের অধিকারী উহা হইতে তাহাকে বঞ্চিত করা অথবা উহার উপর তাহার বৈধ অধিকারে বাধা প্রদান; (আ) সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র প্রদান না করা; (ই) বিবাহের সময় প্রাপ্ত উপহার বা স্ত্রীধন বা অন্য কোনো দান বা উপহার হিসেবে প্রাপ্ত কোনো সম্পদ হইতে সংক্ষুব্ধকে বঞ্চিত করা বা উহার উপর তাহার বৈধ অধিকার প্রয়োগে বাধা প্রদান; (ঈ) সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির মালিকানাধীন যে কোনো স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি তাহার অনুমতি ব্যতিরেকে হস্তান্তর করা বা তাহার উপর তাহার বৈধ অধিকার প্রয়োগে বাধা প্রদান বা (এ) পারিবারিক সম্পর্কের কারণে যে সকল সম্পদ বা সুযোগ-সুবিধাতে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির ব্যবহার বা ভোগদখলের অধিকার রহিয়াছে উহা হইতে তাহাকে বঞ্চিত  করা বা উহার উপর তাহার বৈধ অধিকার প্রয়োগে বাধা প্রদান করাকে বুঝায়। ওই সকল অপরাধ সংঘটিত হইলে যেকোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আদালতে আইনের আশ্রয় লইতে পারিবে। আদালত যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে, পারিবারিক সহিংসতা ঘটিয়াছে বা ঘটিবার সম্ভাবনা রহিয়াছে, তাহা হইলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির পক্ষে সুরক্ষার আদেশ প্রদান করিতে পারিবে এবং যে ব্যক্তি সহিংসতা ঘটাইয়াছে তাহাকে সহিংসতা কাজ করা হইতে বিরত থাকিবার আদেশ প্রদান করিতে পারিবে। উক্ত রূপ আদেশের সঙ্গে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে উক্ত গৃহে বসবাস করিবার জন্য প্রয়োজনীয় সকল আদেশ প্রদান করিতে পারিবে। এই আইনে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের আবেদন করিলে আদালত যেরূপ উপযুক্ত মনে করিবেন সেইরূপ আর্থিক ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারিবেন। আদালত প্রতিপক্ষের প্রতি সুরক্ষার আদেশ দিলে প্রতিপক্ষ সেই আদেশ অমান্য করিলে তিনি অনধিক ৬ মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং এই অপরাধের পুনরাবৃত্তির ক্ষেত্রে তিনি অনধিক ২ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। এই অপরাধের অভিযোগসমূহ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দাখিল করিতে হইবে। এই অপরাধের অভিযোগ আপোসযোগ্য হইবে। সাধারণত যৌথ পরিবারের কোনো পুরুষ সদস্য মারা গেলে তাহার বিধবা স্ত্রী বা নাবালক সন্তানাদি থাকিলে তাহারাই প্রধানত এই অপরাধের বেশি শিকার হইয়া থাকেন।

বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর পরও নারীরা সর্বদা সহিংসতার শিকার হচ্ছে, শিশুরা প্রতিনিয়ত নিগৃহীত হচ্ছে। সংবিধানে নারীর সমতার কথা বলা হলেও নারীরা প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় নারীরা সর্বদাই অবহেলিত, বঞ্চিত, অপমানিত, নিগৃহীত, নিষ্পেষিত। শুধু আইন করেই অপরাধ থামানো যাবে না। আইনের কঠোর প্রয়োগ ও অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় এ অপরাধগুলো যেন পানি-পান্তা। আইন প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক আন্দোলন জোরদার করতে হবে। কেননা সামাজিক আন্দোলন ছাড়া মানুষকে সচেতন করা সম্ভব নয়, আর যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষকে সচেতন করা না যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত এ অপরাধ সমাজ থেকে নির্মূল করা অসম্ভব হইবে।

আইনজীবী