Print Date & Time : 16 June 2025 Monday 4:26 pm

পার্কের প্রয়োজনীয়তা এবং আমাদের উল্টো হাঁটার উপাখ্যান

সাদ্দাম হোসাইন: ভাষাবিজ্ঞানী ও লেখক মুহম্মদ আব্দুল হাইয়ের ‘বিলেতে সাড়ে সাতশ’ দিন’ পড়ছিলাম। সেখানে তিনি ইংরেজদের এবং লন্ডন শহরটার নানা বিষয়বস্তুর কথা বলেছেন অত্যন্ত উপভোগ্যভাবে। এক জায়গায় তিনি বলেছেন, ‘এদের বাড়িঘর রাস্তাঘাট তৈরির মধ্যে যেমন একটা পরিণত পরিকল্পনার ছাপ আছে, তেমনি সময়মতো মুক্ত হাওয়া খেয়ে আসার জন্যও শহরের মাঝে মাঝে এরা পার্ক তৈরি করে রেখেছে। পার্কগুলো শহরের প্রাসাদ সমুদ্রের মধ্যে ছোট ছোট সবুজ দ্বীপের মতো। বদ্ধঘর ও কর্মশালা থেকে বেরিয়ে সারাটা ইংরেজ জাত এই পার্কগুলোতে প্রাণভরে মুক্তি ও আনন্দের স্বাদ গ্রহণ করে। এজন্যই শহরের মাঝে মাঝে এমনিভাবে এত পার্ক…।’  তিনি বলেছেন যে, শহরটাকে বোরো নামে মহল্লায় ভাগ করা আছে এবং প্রতিটি বোরোতে আছে পর্যাপ্ত পার্ক।

ইংরেজ জাতির আছে বলেই আমাদেরও থাকতে হবে, তেমন কোনো কথা নেই। ইংরেজরা পরিকল্পনা করে শহর তৈরি করেছে, আমরা ওসবের ধারে কাছেও যাইনি তাতে এমন কী সমস্যা হয়েছে? সমস্যা আমাদের হয়নি কিছুই, সে আমরা দেখতেই পাচ্ছি।

পার্কের প্রয়োজনীয়তা: খালি চোখে মনে হতে পারে পার্কের তেমন কোনো আর্থিক উপকার নেই। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মানুষ সপ্তাহে কমপক্ষে তিন দিন সবুজের সক্সেগ বা প্রকৃতির সক্সেগ কিছুটা সময় ব্যয় করেন, তাদের উচ্চরক্তচাপ, ডিপ্রেশন, ডিমেনশিয়াসহ নানা ধরনের মানসিক এবং শারীরিক সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা কমে। সাধারণ মানুষকে সুস্থ রাখার একমাত্র উপায় হাসপাতাল নয়, সেটাও আমাদের বুঝতে হবে। বরং জনগণকে হাসপাতালে কম যেতে হলে সেটার অবশ্যই আর্থিক উপকারিতা আছে।

গত বছরের জানুয়ারিতে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। যেটির ভাবার্থ এ রকমÑ সবুজ স্থানের কাছে গেলে শহরের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং মাদকে আসক্তির আশঙ্কা কমে।

তাতে বলা হয়েছে, …২০১৫-১৬ বর্ষে ফিনিস ইনস্টিটিউট অব হেলথ ফিনল্যান্ডের হেলসিংকি, এপসো ও ভান্তা শহরের ১৬ হাজার মানুষের ওপরে গবেষণা পরিচালনা করে। গবেষণায় ওঠে এসেছে, যেসব মানুষ সপ্তাহে তিন থেকে চারবার সবুজ স্থানে বা শহরের সবুজ পার্কে যায় তাদের মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ এগুলো হওয়ার আশঙ্কা তিনভাগের একভাগ কমে যায় এবং মাদকাসক্ত হওয়ার আশঙ্কা চারভাগের একভাগে নেমে আসে।

পার্কে সহজগম্যতা কেন বেশি দরকার: ওই গবেষণায় বিশেষভাবে যেটি পাওয়া যায় সেটা হচ্ছে প্রকৃতির সান্নিধ্য সবচেয়ে বেশি কাজে আসে স্বল্প আয়ের মানুষদের। সম্ভবত প্রকৃতি মাতা তার দরিদ্র সন্তানদের বেশি উপকার করার ইচ্ছা পোষণ করেন।

সে কারণে শহরের কম আয়ের মানুষ যেন সহজে নগরের সবুজ স্থানে বেশি যেতে পারে, সেই ব্যবস্থা করা। কিন্তু আমাদের দেশে ঘটনা ঠিক যেন উলটো। শহরের অভিজাত এলাকাগুলোয় রয়েছে সবুজ স্থান। যেমনÑ গুলশানে জাস্টিস শাহাবুদ্দিন আহমেদ পার্ক, ধানমন্ডিতে ধানমন্ডি লেক, সেগুনবাগিচা এলাকায় রমনা পার্ক ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। এসব পার্কের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ, তদারকি ও নিরাপত্তা বিধান করা হয়। তা করা উচিতও বটে।

অন্যদিকে সীমিত আয়ের কর্ম ও পেশাজীবী মানুষের এলাকা বা অভিজাত বলে পরিচিত নয়; তেমন এলাকাগুলোয় হয় পার্ক নেই বা থাকলেও সেখানে প্রবেশের কায়দা নেই। এটা পরিহাস বৈকি!

রাজধানীর মিরপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেন ছিল এর ব্যতিক্রম। তথাকথিত অভিজাত এলাকা বলে পরিচিত না হলেও বোটানিক্যাল গার্ডেন স¤প্রতি যথেষ্ট ভালো ব্যবস্থাপনার অধীনেই ছিল। কিন্তু স¤প্রতি বন অধিদপ্তর এক লাফে এখানে প্রবেশ ফি ২০ থেকে ১০০ টাকা করেছে এবং শরীর চর্চার জন্য দেওয়া হয়েছে মাত্র এক ঘণ্টা এবং ভোরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে বার্ষিক ৫০০ টাকার টিকিটের বিনিময়ে।

রাজধানীতে মুক্ত পার্কের প্রয়োজনীয়তা বেশি: নগরবাসীর সরকারি স্বাস্থ্যসেবার মান এক অর্থে তলানিতে। সরকারি হাসপাতালগুলোয় লম্বা লাইনে দাঁড়াতে গিয়ে সুস্থ মানুষকেও অসুস্থ হয়ে যেতে হয়। রোগীর অনুপাতে ডাক্তার কম, ডাক্তারদের সরকারি মেডিকেলে সেবা প্রদানে অনীহা প্রভৃতি কারণ তো আছেই। কিন্তু এর সক্সেগ যদি ন্যাচারাল হিলিংয়ের জন্য যে পার্কের দরকার সেই অধিকারেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়; তাহলে শহরের মানুষ কোথায় যাবে? চিকিৎসা না হয় না দিলে, যাতে সুস্থ থাকতে পারি সেই অধিকারটুকু অন্তত কেড়ে নিও না।

এমনিতেই ঢাকা শহরের বাতাস দূষিত, অপরিকল্পিত নগরী, শহরের খালগুলোর গন্ধে টেকা যায় না। জীবনযাপনের এমনই বিশৃঙ্খলায় শহরের মানুষের ভীষণ চাপের মুখে একটুখানি নিশ্বাস নেওয়ার মতো জায়গা হলো পার্ক।

শরীরচর্চা করবেন, শহরের ফুটপাত দিয়ে আপনি হাঁটতে পারবেন না। অনেক স্থানে ফুটপাত বলে কিছু নেই, আছে দোকান। ফুটপাত থাকলেও সেটা দখল করে রাখা হয়েছে ইট, বালি, সিমেন্ট, দোকানপাট ইত্যাদি দিয়ে। শরীরচর্চা করার জন্য একমাত্র উপযুক্ত স্থান রয়েছে পার্ক। সেখানে ঢুকতে যদি প্রতিবার ১০০ টাকা করে লাগে তাহলে বেনজীর বা মতিউরদের মতো টাকা ইনকাম ছাড়া পথ থাকবে না।

শরীরচর্চার সময়: স¤প্রতি বোটানিক্যাল গার্ডেনে শরীরচর্চার সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে সাড়ে ৬টা থেকে সাড়ে ৭টা। এটাই যে একমাত্র শরীরচর্চার সময় সেটা তাদের কে বলেছে আমার জানা নেই। ঢাকা শহরে শুধু অফিসগামী মানুষই আছে, ব্যাপারটা তেমন নয়।  এখানে আছে মুক্ত পেশাজীবী (ফ্রিল্যান্সার); যাদের রাত জেগে কাজ করতে হয়, আছে রাত্রে ডিউটি করতে হয় এমন পেশার লোকজন। শুধু সকালেই যদি শরীরচর্চার সময় বেঁধে দেওয়া হয় তাহলে সেটা এক শ্রেণির শরীরচর্চার অধিকারকেই অস্বীকার করা হয় এবং শরীরচর্চার অধিকারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। বোটানিক্যাল গার্ডেনে ৫০০ টাকা দিয়ে যে শরীরচর্চার পাসটা দেওয়া হবে সেটা সকালের এক ঘণ্টাতে আটকে রাখাটা সম্পূর্ণই অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত।

পার্কে প্রবেশাধিকার রাইট টু লাইফ: পার্কে সবুজের সক্সেগ সময় কাটালে অনেক শারীরিক এবং মানসিক রোগ থেকে মুক্ত থাকা যায়। শরীরচর্চার জন্য পার্ক ছাড়া তেমন কোনো জায়গা অবশিষ্ট নেই। একজন মানুষকে এগুলোতে প্রবেশের পথে বাধা তৈরি করা নিতান্তই অমানবিকই নয়, অসাংবিধানিকও বটে।

আমাদের সংবিধানের ৩২ নং অনুচ্ছেদে জীবনের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ১৮ অনুচ্ছেদে জনস্বাস্থ্য রক্ষার প্রতিশ্রæতি এবং ১৮ক নং অনুচ্ছেদে প্রকৃতি নাগরিকদের জন্য রক্ষার কথাই বলা হয়েছে। প্রকৃতির সান্নিধ্য উপভোগ এবং শরীরচর্চা যে সরাসরি জীবনের এবং সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন সেটা ব্যাখ্যা না করলেও কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। যে ব্যক্তি ইতোমধ্যেই অর্থনৈতিকভাবে পীড়িত, অবসাদগ্রস্ত, তার দরকার কিছুক্ষণ সবুজের সান্নিধ্যে সময় কাটানো। কিন্তু ১০০ টাকা প্রবেশ ফি দিয়ে যদি তাকে পার্কে প্রবেশ করতে হয় তাহলে তার জন্য সেটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে, তার অবসাদ না কমে বরং আরও বেড়ে যাবে।

নীতি নির্ধারকদের চোখ নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার প্রতি: নীতি নির্ধারকদের দৃষ্টি থাকা উচিত কোথায় নাগরিকদের সমস্যা হচ্ছে, সেটার প্রতি। একটা  দায়িত্বশীল সরকারের উচিত তেমনটাই হওয়া। কিন্তু স¤প্রতি দেখা যাচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেন অসাধুকে তুষ্ট এবং সাধারণ মানুষের অধিকার খর্ব করতেই বেশি আগ্রহী। সরকার একদিকে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে অসাধু মানুষকে সুযোগ দিচ্ছে কর ফাঁকি দিতে, অন্যদিকে সেই করের বোঝা সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকার ওপরে চাপিয়ে দিচ্ছে। বিদ্যুৎ খাতে ক্যাপাসিটি চার্জ শুধু শুধু দিয়ে ধনীদের আরও বিত্তশালী করছে আর যখন টাকার ভান্ডারে টান পড়ছে তখন পার্কে প্রবেশ মূল্য বৃদ্ধি, মেট্রোরেলের টিকিটের দামে ভ্যাট আরোপ প্রভৃতি যেন সরকারের তেমন নীতিরই প্রতিফলন। কারণ সাধারণ মানুষের প্রতিকারের জায়গা নেই। সরকারের জবাবদিহির জায়গা যেন জনগণ নয়, কালোটাকার মালিকেরা।

অনেকের গল্পটি জানা থাকার কথা। গ্রিক বীর মহামতি আলেকজান্ডার একবার দার্শনিক ডায়োজিনিসের কাছে গেলেন। ডায়োজিনিস তখন রোদ পোহাচ্ছিলেন। আলেকজান্ডার তার রোদকে ভুলবশত আড়াল করে দাঁড়িয়ে ডায়োজিনিসকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি আমার কাছে কী চান, বলুন। তিনি বললেন, ‘যা দিতে পারবেন না, তা থেকে আমাকে বঞ্চিত করছেন করেন।’ মহাবীরকে রোদ ছেড়ে সরে দাঁড়াতে বললেন ডায়োজিনিস। এটাই না কি ন্যাচারাল রাইটসের উৎপত্তি।

আমাদের নাগরিকদের চাওয়ার বেশি বেশি কিছু নেই। আমরাও বলি, দয়া করে আপনারা আমাদের প্রকৃতি দিতে হবে না, বরং দয়া করে যতটুকু আছে ততটুকুতে প্রবেশাধিকার দিলেই আমরা খুশি হব। এটা জনগণের প্রাকৃতিক এবং মৌলিক অধিকার।

সদস্য, ঢাকা বার অ্যাসোসিয়েশন

যড়ংংরহংধফফধসরঃংÑমসধরষ.পড়স