পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় পরিচয়

কাজী জহিরুল ইসলাম  : বাংলাদেশের ভৌগোলিক, প্রাকৃতিক, নৃতাত্ত্বিক ও পর্যটনশিল্পের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। পার্বত্যাঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এর আলাদা কদর রয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় এক-দশমাংশ এলাকা নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম এদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িÑএ তিনটি প্রশাসনিক জেলা নিয়ে গঠিত হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা। এর মোট আয়তন পাঁচ হাজার ৯৩ বর্গমাইল বা ১৩ হাজার ১৮৪ বর্গকিলোমিটার। চট্টগ্রাম বিভাগের এই এলাকা পাহাড় ও উপত্যকায় পূর্ণ বলে এর নামকরণ করা হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। পাহাড়-পর্বতে ঘেঁষা, গাছগাছালি, বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ এবং সেখানকার উপজাতীয় সমাজ-সংস্কৃতির জন্য এ অঞ্চল দেশি-বিদেশি সবার প্রাণ কেড়ে নেয়।

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৩টি জনগোষ্ঠী বসবাস করে। তার মধ্যে বাঙালি ছাড়া বাকি ১২টি জনগোষ্ঠী উপজাতি। জনসংখ্যার দিক থেকে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাঙালি জনগোষ্ঠীর পরে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো বা মুরং, তঞ্চঙ্গ্যা, ব্যোম, পাংখোয়া, চাক, খুমী, লুসাই বা মিজো, কুকি বা চিন জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। এরা মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত। এসব সম্প্রদায়ের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি আছে। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমল এবং স্বাধীনতার পরবর্তী বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে গিয়ে পার্বত্য জেলায় বাংলাদেশিরা বসবাস করে আসছে। ব্যবসা-বাণিজ্য বা জীবিকানির্বাহের জন্য অনেক বাঙালি জনগোষ্ঠী মোগল আমল বা ব্রিটিশ আমল থেকে বসবাস করছে। বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে মুসলিম, হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের লোকজন আছে। কিছু ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টানও আছে।

বাঙালি জনগোষ্ঠীর বাইরে রয়েছে ১২টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়। এসব সম্প্রদায়ের আদিবাস ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান, তিব্বত, চীন, থাইল্যান্ড  প্রভৃতি দেশে। সময়ের বিবর্তনে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তারা বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করছে। ব্রিটিশ আমলেই বিভিন্ন উপজাতি পার্বত্য চট্টগ্রামে আসে। ব্রিটিশ আমলের আগেও চাকমাদের আগমনের ইতিহাস জানা যায়। মূলত ১৭০০ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে পার্বত্য অঞ্চলে চাকমাদের আগমন ঘটে। তাদের আগমন সম্পর্কে নৃতাত্ত্বিকদের দুটি মতভেদ রয়েছে। একদল নৃতাত্ত্বিক মনে করেন, তাদের আগমন ঘটে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড থেকে। আবার অন্যদল বলেন, চাকমাদের সমাজ, সংস্কৃতি ও ভাষার সঙ্গে আসাম ও ত্রিপুরার চাকমাদের অনেক মিল আছে। সেজন্য আসাম ও ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশে চাকমাদের আগমন হয়েছে বলে তারা মনে করেন। এছাড়া মিয়ানমার থেকে বর্মীদের আক্রমণের শিকার হয়ে ১৭৮৪ সালে মারমারা বাংলাদেশে আসে। ত্রিপুরারা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য এবং ম্রোরা মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য থেকে আসে। চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরাদের মতো বাদবাকি সম্প্রদায়ও বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী ভারত ও মিয়ানমারসহ বিভিন্ন রাজ্য থেকে এসে বসবাস করছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্মের দিক থেকে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এর পরে বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, হিন্দু ও ক্রামা ধর্মের অবস্থান। বাঙালিদের মধ্যে বেশিরভাগ মুসলিম। এছাড়া বাঙালি হিন্দুরা হিন্দুধর্ম ও বডুয়ারা বৌদ্ধধর্মের অনুসারী। উপজাতিদের মধ্যে বৌদ্ধ এবং খ্রিষ্টধর্মের অনুসারী বেশি। তারপরে হিন্দু, ক্রামা, প্রকৃতি পূজারি এবং ধর্মান্তরিত মুসলিমও আছে। একসময় এখানে খ্রিষ্টধর্মের নাম-গন্ধ না থাকলেও বর্তমানে বৃদ্ধির হারের দিক থেকে খ্রিষ্টধর্মই অগ্রসর। খ্রিষ্টান এনজিও ও মিশনারিদের শিক্ষা, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন সেবামূলক সুবিধা প্রদান ও ধর্মান্তর কার্যক্রমের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে তারা বিভিন্ন উপজাতিকে খ্রিষ্টান বানাতে সক্ষম হচ্ছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ উপজাতীয় সম্প্রদায় এখন খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে। বৌদ্ধধর্মাবলম্বী চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, চাক ব্যতীত অন্যান্য সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠী অধিকাংশই খ্রিষ্টান। পাংখোয়া, ব্যোম, লুসাই ও কুকি প্রকৃতি পূজারিÑএ জনগোষ্ঠীগুলো বর্তমানে শতভাগ খ্রিষ্টধর্মের অনুসারী। খেয়াং, খুমী ও ত্রিপুরারাও অধিকাংশ খ্রিষ্টান। বৌদ্ধধর্মের অনুসারী খুমী জনগোষ্ঠী বর্তমানে ৬২ দশমিক ৮০ শতাংশ খ্রিষ্টধর্মের অনুসারী। ত্রিপুরারা সনাতন ধর্মাবলম্বী হলেও বান্দরবানের প্রায় সবাই খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে। খাগড়াছড়ির ত্রিপুরাদের মধ্যে অনেকে এখনও হিন্দুধর্মের অনুসারী। প্রকৃতি পূজারি ম্রো জনগোষ্ঠী বেশিরভাগ ক্রামা ধর্মের অনুসারী হলেও অনেকে খ্রিষ্টান এবং কেউ কেউ বৌদ্ধধর্মের অনুসারী। ধর্মের দিক থেকে চাকমা, মারমা, চাক ও তঞ্চঙ্গ্যারা এখনও বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। তবে এসব সম্প্রদায়ের লোকজনও খ্রিষ্টান হচ্ছে। ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টান হওয়া থেকে বাদ নেই বাঙালি জনগোষ্ঠীও।

ধর্মান্তর পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের মধ্যে কমন হয়ে উঠেছে। এর ফলে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর প্রথা, মূল্যবোধ, সমাজ ও সংস্কৃতিতে প্রভাব বিস্তার করে। ধর্মান্তরের ফলে কয়েক দশকের মধ্যে একটা জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রিত আত্মপরিচয় নির্মিত হয়। এক্ষেত্রে তাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির সঙ্গে নতুন ধর্মীয় প্রথা ও মূল্যবোধের একটা দ্বন্দ্ব^ তৈরি হয়, যার ফলে নতুন ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে চলতে গিয়ে তাদের ঐতিহ্যের অনেক বিষয়কে বিসর্জন দিতে হয়। ক্রমান্বয়ে তাদের ঐতিহ্যবাহী সমাজ-সংস্কৃতির বিলুপ্তি ঘটে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালি জনগোষ্ঠী এদেশীয় সমাজ-সংস্কৃতি ও তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হয়। এতে যুক্ত হচ্ছে আধুনিক সংস্কৃতির প্রভাব। বৌদ্ধধর্মাবলম্বী উপজাতিরা ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির পাশাপাশি আধুনিকতা ও তাদের বৌদ্ধধর্মীয় প্রথা ও মূল্যবোধের আলোকেই পরিচালিত হয়। তবে যেসব উপজাতি খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে, তারা ক্রিস্টিয়ানিটির আলোকে নিজেদের পরিচালিত করতে গিয়ে ঐতিহ্যবাহী ধর্ম, সমাজ-সংস্কৃতির অনেক উপাদান, প্রথা ও মূল্যবোধের বিলুপ্তি ঘটাতে বাধ্য হয়। সে জায়গায় চর্চিত হয় খ্রিষ্টান ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয়। তবে তাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির অনেক বিষয় দেউলিয়া হলেও কিছু উপাদান তাদের জীবনে মিশে আছে। বর্তমানে পার্বত্যাঞ্চলে ধর্মান্তরিত উপজাতিদের মধ্যে তাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির সঙ্গে খ্রিষ্টধর্মের প্রথা, মূল্যবোধ ও আধুনিক পাশ্চাত্য সংস্কৃতির মেলবন্ধন পাওয়া যায়।

সাবেক শিক্ষার্থী, ফোকলোর বিভাগ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

kajijahirulislam111@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০