সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম ইপিজেডের প্রবাসী বিনিয়োগকারী নাজমুল আবেদিন। ব্যাংকিং পেশায় অনিয়মের অভিযোগে চাকরিচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়ে লন্ডনে পাড়ি জমান। এর কয়েক বছর পর দেশে ফিরে পোশাক খাতের ব্যবসায় আসেন। ব্যবসার নামে চার ব্যাংক থেকে নেওয়া প্রায় ৩৩৪ কোটি খেলাপি ঋণ, শ্রমিকের বেতন, সরবরাহকারী বকেয়া পাওনা এবং সরকারি বিভিন্ন ধরনের চার্জ বকেয়া রেখে ২০১৯ সালের মাঝামাঝি আবারও লন্ডনে পালিয়ে যান। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার ব্র্যাক ব্যাংকের চেক প্রতারণার মামলায় চট্টগ্রামের একটি আদালত তাকে এক বছর জেল ও ৯৩ কোটি জরিমানার রায় দেন।
চট্টগ্রামের প্রথম যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালত ও ব্র্যাক ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ৯৩ কোটি ৭৯ লাখ টাকার চেক প্রতারণার অভিযোগে ব্র্যাক ব্যাংকের দায়ের করা মামলায় এএন্ডবি আউটফিট লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও মাইকেল কোল্ড এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল আবেদিনকে এক বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একইসঙ্গে তাদের ৯৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকার অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার (৩ মার্চ) চট্টগ্রামের প্রথম যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালত এ রায় দেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ব্র্যাক ব্যাংকের পক্ষের আইনজীবী মো. নাঈম ভূঁইয়া।
মামলার নথি বিশ্লেষণ করে জানা যায়, ২০২০ সালে ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড এএন্ডবি আউটফিট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ৯৩ টাকা ৭৯ লাখ টাকার চেক প্রতারণার অভিযোগে চকবাজার থানায় (সিআর-২৪৬/২০) একটি মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীতে আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় চট্টগ্রামের প্রথম যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালত তাদের এক বছর কারাদণ্ড দেন। একইসঙ্গে আসামিদের ৯৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকার অর্থদণ্ড প্রদান করেন।
ব্যাংক কর্মকর্তা ও ইপিজেড-সংশ্লিষ্টরা বলেন, নাজমুল আবেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে পড়াশোনা শেষ করে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে জয়েন করেন। কিন্তু পেশাগত অনিয়মের অভিযোগে চাকরিচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়ে লন্ডনে পাড়ি জমান। এর কয়েক বছর পর দেশে ফিরে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলে পোশাক খাতের ব্যবসায় আসেন। এর মধ্যে এএন্ডবি আউটফিট, নর্ম আউটফিট লিমিটেড এবং কোল্ড স্কুল প্লে লিমিটেড নামে তিনটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে।
নিজের ব্যাংকে কাজের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে অল্প মূলধনি প্রতিষ্ঠানকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে উপস্থাপন করে ব্যাংকগুলো থেকে বড় অংকের ঋণ হাতিয়ে নেন। এর মধ্যে এএন্ডবি আউটফিট কাছে ব্র্যাক ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ১০১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা এবং মার্কেন্টাইল ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় ১২৩ কোটি। পাশাপাশি নর্ম আউটফিটের কাছে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার প্রায় ৭৫ কোটি ও ওয়ান ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ৩৫ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। অর্থাৎ দেশের চারটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন ৩৩৪ কোটি টাকা।
একই সঙ্গে তিন পোশাক কারখানার এক হাজার ৯০৮ শ্রমিকের বেতন-ভাতা, বেপজার পাওনা আর অ্যাকসেসরিজ সাপ্লায়ারদের আরও অন্তত ৫৩ কোটি টাকা না দিয়েই গোপনে ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী এই ব্যবসায়ী ২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে পরিবার নিয়ে যুক্তরাজ্যে পাড়ি দেন।
চট্টগ্রাম ইপিজেডের কর্মকর্তারা বলেন, প্রথমে এএন্ডবি আউটফিট লিমিটেড দিয়ে শুরু করেন। এরপর ২০১৭ সালের শেষ দিকে স্ত্রী সোহেলা আবেদীন ও শ্বশুর এ কে এম জাহেদ হোসাইনের নামে নর্ম আউটফিট নামের কারখানাটি কিনে নেন নাজমুল। যদিও এএন্ডবি আউটফিটের সাব কন্ট্রাক্টের কাজ করত নর্ম আউটফিট। সেই প্রতিষ্ঠানটি মাত্র এক বছরের ব্যবধানে কীভাবে ব্যাংক থেকে ৭৫ কোটি টাকা ঋণ পেল সেটাই আমাদের কাছে রহস্যজনক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্র্যাক ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, নাজমুল আবেদিন একসময়ে ভালো ব্যাংকার ছিলেন। তিনি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের চৌকস কর্মকর্তা ছিলেন। কিন্তু পেশাগত অনিয়মের অভিযোগে চাকরিচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়ে লন্ডনে পাড়ি জমান। এর কয়েক বছর পর দেশে ফিরে পোশাক খাতের ব্যবসায় আসেন। অতীতের পরিচিতি এবং দক্ষতা কাজে লাগিয়ে কাঁচামাল আমদানির এলসি ও পরিচালন মূলধন হিসেবে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে সহজে কোটি কোটি টাকা ঋণ নেয়। পরে আর ফেরত দেননি।
অপরদিকে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, নাজমুল আবেদিনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান আমাদের খেলাপি গ্রাহক। আড়াই বছর আগে তিনি দেশ ছেড়ে চলে যান। আর দেশে আসেননি। তখন থেকে প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে পড়ে। এখন ইপিজেড কর্তৃপক্ষ বন্ধ থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো নিলাম বিক্রয় করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছিল।