পাল্টাপাল্টি যুক্তি

শামসুন নাহার: রিলায়ান্সের বিরুদ্ধে ভারতের পার্লামেন্টে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। মাত্র এক দশক সময়ের মধ্যে শূন্য থেকে শিখরে ওঠা কোম্পানির বিরুদ্ধে কথা বলার সুযোগ পেয়ে কেউ কেউ আবেগে একটু বেশিই বলে ফেললেন হয়তো। সংসদ সদস্য এ জি কুলকারনি তো কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই রিলায়ান্স স্কিমের সঙ্গে রিজার্ভ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নরের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করে ফেললেন। এ পরিস্থিতি শান্ত করতে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী বলেন, রিলায়ান্সের ব্যাপারটি গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখা হচ্ছে এবং তদন্তের পর আইন অনুযায়ীই উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ওদিকে গুরুমূর্তি আরেক অভিযোগ নিয়ে লেখা শুরু করেছেন। তিনি লিখলেন, রিলায়ান্স হলো এমন এক ধুরন্ধর কোম্পানি, যা ১০০ কোটি মূল্যের ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্লান্ট চোরাকারবারি করেছে। আমরা জানি লোকে ঘড়ি, রেডিও, রেকর্ডার, ভিডিও ইত্যাদি জিনিস ভারতে চোরাচালান করে। এর চেয়ে বড় গ্রুপ চোরাচালানের মাধ্যমে আনে সোনার বার (ইগনট) ও নেশাদ্রব্য। কিন্তু আমাদের দেশে এমন চোরাকারবারি আগে ছিল না যে, বিরাট বিরাট ফ্যাক্টরিই স্মাগলিং করে নিয়ে আসতে পারে। এমনটিই করেছে রিলায়ান্স। ১৯৮৫ সালের শেষদিকে ও ১৯৮৬ সালের শুরুর দিকে রিলায়ান্স সমুদ্রযোগে ও আকাশপথে বার্ষিক ৪৫ হাজার টন পলিয়েস্টার স্ট্যাপল ফাইবার উৎপাদনকারী প্লান্টের উপকরণ আমদানি করে। আসলে, এই চালানের সঙ্গে আরও ২৫ হাজার টন পলিয়েস্টার ফিলামেন্ট সুতা প্রস্তুতকারী সম্পূর্ণ ভিন্ন আরেকটি প্লান্টের উপকরণও আমদানি করে আনে রিলায়ান্স। অথচ এর জন্য আলাদা কোনো আমদানির লাইসেন্স পায়নি কোম্পানিটি। এটা রিলায়ান্সের চোরাচালানির তৃতীয় ঘটনা। এর আগে ১৯৮২ সালে ১০ হাজার টন সুতা প্রস্তুতকারী প্লান্টের উপকরণ আমদানির লাইসেন্স নিয়ে প্রকৃতপক্ষে আমদানি করেছে ২৫ হাজার টন। পরে ১৯৮৪ সালে প্রণব মুখার্জির ‘পুনঃঅনুমোদন’ স্কিমের মাধ্যমে এ আমদানিকে বৈধ করা হয়। একই সঙ্গে এ স্কিম রিলায়ান্সের পলিকনডেন্সেশন (পলিয়েস্টার উৎপাদন) ইউনিট ও স্পিনিং লাইনের (পলিয়েস্টারকে সুতায় রূপান্তর) জন্য দরকারি ব্যালান্সিং ইকুইপমেন্ট (সামঞ্জস্যপূর্ণ উপকরণ) আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে ১৯৮৫ সালের গোড়ার দিকে ১৮ কোটি ৩৮ লাখ রুপি মূল্যের ব্যালান্সিং ইকুইপমেন্ট আমদানির সুযোগ পায় রিলায়ান্স। এই পরিমাণ ব্যালান্সিং ইকুইপমেন্ট দিয়ে বিলায়ান্স স্থাপন করেছে আরেকটি প্লান্ট, যা অন্তত বার্ষিক ২০ হাজার টন পলিয়েস্টার উৎপাদন করতে পারে। চোরাইভাবে আনা তৃতীয় প্লান্টসহ রিলায়ান্সের পাতালগঙ্গা প্রজেক্টের এখন মোট উৎপাদন ক্ষমতা বছরে ৭০ হাজার টন। অথচ সব মিলিয়ে ২৫ হাজার ১২৫ টনের লাইসেন্স অনুমোদন পেয়েছে রিলায়ান্স।

এ রিপোর্টের ফলোআপ নিবন্ধও ছেপেছিল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। এক্সপ্রেস বাদেও আরেকজন প্রভাবশালী প্রকাশকের আক্রমণ আসে আম্বানির ওপর। তিনি হলেন আর ভি পণ্ডিত। পণ্ডিতের মাসিক ম্যাগাজিন ‘ইমপ্রিন্ট’ ১৯৮৬ সালের জুলাই থেকে রিলায়ান্সের বিরুদ্ধে লেখা শুরু করে। পণ্ডিত এর আগে হংকংয়ের প্রকাশক আদ্রিয়ান জেকার সঙ্গে কাজ করেছেন। পরে ওয়াদিয়া পরিবারের সহায়তায় মুম্বাইয়ে ম্যাগাজিন ও মিউজিক ফার্ম শুরু করেন তিনি। ওয়াদিয়া পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা নিয়ে কখনোই রাখঢাক করেননি পণ্ডিত। আর রিলায়ান্স নিয়ে নতুন কোনো তথ্যও হাজির করেননি। কেবল পুরোনো অভিযোগগুলোই নিজের মতো করে সাজিয়ে উপস্থাপন করেছেন। এক্সপ্রেস, ব্লিটস ও ইমপ্রিন্ট বাদে ব্যবসা-বাণিজ্যবিষয়ক পত্রিকাগুলো আম্বানির বিরুদ্ধে তেমন কিছু লেখেনি। বরং এ প্রসঙ্গে তাদের ভাষ্যে ফুটে উঠেছে মুগ্ধতা। আম্বানির বুদ্ধি, সাহস ও মেধার তারিফই করেছে নানা পত্রিকা। এক্সপ্রেসের ‘লোন মেলা’ আর্টিকেলের পর বিজনেস ইন্ডিয়া লিখেছে, এসব অভিযোগ খুবই গুরুতর, সন্দেহ নেই। কিন্তু বেশিরভাগ করপোরেট বলয়ে আম্বানির প্রতি শ্রদ্ধার ভাবই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যসংক্রান্ত আইন ও নিয়মকানুনের যে জটিল জাল ভারতের ব্যবসাজগৎকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছে, তারই বিরুদ্ধে চপেটাঘাত করেছেন আম্বানি। এছাড়া বিরাট অঙ্কের অর্থ ব্যবস্থাপনায় যে দক্ষতা তিনি দেখিয়েছেন তা অতুলনীয়।

বিজনেস ইন্ডিয়ার লেখক মুক্কারাম ভগত ও দিলীপ শেরিয়ান লিখেছেন, আসলে রিলায়ান্সের আগে ব্যাংকগুলোকেই দোষ দেওয়া উচিত। তথাকথিত লোন মেলা ভারতে একেবারে নতুন কিছু নয়। কিন্তু আম্বানি যে মাত্রায় ও যতটা দক্ষতার সঙ্গে ব্যাপারটি ব্যাংকের ঘাড়ে চাপিয়েছেন সেদিক থেকে রিলায়ান্সের ব্যাপারটি অনন্য। এতে প্রকৃতপক্ষে দেশের ব্যাংকিং সিস্টেম ও আমলাতন্ত্রের অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ যে কতটা ফাঁপা তাই-ই প্রকাশ পায়।

রিলায়ান্সের পক্ষের একজন বন্ধু ছিলেন দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ার সম্পাদক গিরিলাল জাইন। একমাত্র টাইমসই নন-কনভার্টিবল ডিবেঞ্চারের কনভারশন বাতিল করার বিপক্ষে লিখেছিল। পত্রিকাটি প্রশ্ন তুলেছিল, অসাধু ব্যবসাকে প্রতিহত করার জন্যই যদি এ নিয়ম বাতিল করা হয় তাহলে ছয় মাস আগে থেকেই যখন ডিবেঞ্চারের দাম বাড়ছিল, তখনই কেন কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি? কেন রিলায়ান্সকে তারা বিশ্বাস করিয়েছে যে, কনভারশন বাস্তবায়ন করা হবে? প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়ার পর কেন এত দেরি করে ৪ জুনে এ সিদ্ধান্ত জানানো হলো? গিরিলালের প্রশ্নে রিলায়ান্সের বিনিয়োগকারীদের মনের অবস্থাই ফুটে ওঠে বটে। কয়েকদিন পরে বিরোধী একটি পত্রিকায় প্রকাশ করা হলো, গিরিলাল নিজেই রিলায়ান্সের এফ সিরিজের ১০০ রুপির তিন হাজার ডিবেঞ্চার কিনেছেন। পাশাপাশি আরও জানা যায়, এ ডিবেঞ্চার কেনার জন্য ব্যাংক অব ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ইন্টারন্যাশনাল (বিসিসিআই) থেকে লোন নিয়েছিলেন তিনি। বিসিসিআইয়ের মুম্বাই ব্রাঞ্চের একটি চিঠির মাধ্যমে রিজার্ভ ব্যাংককে এ লোনের ব্যাপারটি নিশ্চিত করা হয়। বোঝানো হয় যে, রিলায়ান্সই আসলে গিরিলালকে লোন পাইয়ে দিয়েছে। রিলায়ান্স অবশ্য গিরিলাল এ ব্যাপারে কোম্পানির সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে। কিন্তু অভিযোগ তো একটিই নয়। একের পর এক অভিযোগ দিয়ে সফলতার শিখর থেকে টেনে নামানোর চেষ্টা চলছে সর্বত্র। এর শেষ দরকার। ধীরুভাই সিদ্ধান্ত নিলেন, সরাসরি জনগণের উদ্দেশে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করবেন তিনি। জুলাইয়ের শেষে ভারতের সব কাগজে, এমনকি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসেও ১৫ পৃষ্ঠার বিজ্ঞাপন দিলেন আম্বানি। রিলায়ান্সের পক্ষ থেকে বক্তব্য তুলে ধরা হলো এভাবে:

সম্প্রতি আমাদের বার্ষিক সাধারণ সভায় ৩০ হাজার বিনিয়োগকারীর সামনে রেখে যখন আমাদের চেয়ারম্যান বললেন, এফ সিরিজের একটি ডিবেঞ্চারও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রিলায়ান্স ম্যানেজমেন্টের কেউই নিজেদের হাতে রাখেনি, তখন এটি আরেক নতুন বিতর্কের জš§ দিয়েছিল। যেন কোনো উত্তরই তাদের মনঃপূত নয়। অথচ এমন প্রশ্ন তো ওঠারই কথা নয়। কারণ এফ সিরিজের ডিবেঞ্চার কেনার জন্য ১৩০ কোটি রুপি বেশি নিবন্ধন করা হয়, যা রিলায়ান্সকে ফিরিয়ে দিতে হয়েছিল। করপোরেট বিনিয়োগকারীদের থেকে মাত্র ১৬ কোটি রুপি এসেছে। কোম্পানিতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির চেষ্টা তো দূরে থাক, মালিকপক্ষ তাদের হোল্ডিং উল্টো কমাতে চেষ্টা করছে। কঠোর পরিশ্রম ও উদ্ভাবনী ক্ষমতার সমন্বয় ঘটিয়েই সবার ওপরে উঠেছে রিলায়ান্স। ব্যাংকের কাছ থেকে এক পয়সা ঋণ না নিয়ে একের পর এক নতুন প্রজেক্ট স্থাপন করেছে রিলায়ান্স।

নৈতিকতার প্রশ্নেও জবাব দিয়েছে আম্বানির প্রতিষ্ঠার। তারা লিখেছে, ব্যবসায়িক নৈতিকতা রক্ষা করে চলা রিলায়ান্সের প্রধান নীতি। একটি কোম্পানিকে এগিয়ে যেতে হলে যে কোনো মূল্যে ব্যবসায়িক মূল্যবোধকে ধারণ করতে হবেÑএটিই আমাদের পরিচালনা পর্ষদের মূল গাইডলাইন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমাদের সেকেলে হয়ে থাকতে হবে। রিলায়ান্স সামনে এগিয়ে যেতে ও নতুনত্বকে গ্রহণ করতে পিছপা হয়নি কখনও। ব্যবসায়ের স্বাভাবিক ঝুঁকি আমাদের নিতেই হবে। কখনও কখনও অস্বাভাবিক ঝুঁকিও নিতে হবে। কারণ আমাদের লক্ষ্যÑবিনিয়োগকারীরা বিশ্বাস করেন যে অর্থ আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন তার বিনিময়ে সেরা প্রতিদানটি তাদের ফিরিয়ে দেওয়া। এ বছরও ২৫ কোটি ৭৫ লাখ রুপি ডিভিডেন্ড তুলে দিয়েছি তাদের হাতে, যা ভারতের করপোরেট ইতিহাসে সর্বোচ্চ। অন্যদের মতো কেবল চেয়ারে বসে বসে মার্কেট পলিসি বা ব্যাংকিং সিস্টেমের খুঁত ধরতে থাকলে এটা আমাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। করপোরেট কোম্পানিগুলোর গতিশীল চিন্তাভাবনার জোরেই গতি পায় দেশের অর্থনীতি, সামনে এগিয়ে যায় দেশ। দেশের শেয়ার বাজারকে চাঙ্গা করতে রিলায়ান্স ভূমিকা রেখেছে বটে। কিন্তু তা নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে নয়। প্রবৃদ্ধিকে আমরা খুবই গুরুত্ব দিই, কিন্তু সম্মানের চেয়ে বেশি নয়। মুনাফা অর্জন আমাদের লক্ষ্য কিন্তু তা হতে হবে বিশ্বস্ততার সঙ্গে।

রিলায়ান্সের পক্ষ থেকে এ বয়ান প্রকাশ করা হলেও প্রতিপক্ষকে নিরস্ত করা যায়নি। এমনকি রিলায়ান্সের বক্তব্যের পুরো সিরিজ প্রকাশিত হওয়ার আগেই ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পাল্টা যুক্তি দেওয়া শুরু করল। এক্সপ্রেস লিখল, এফ সিরিজের একটি ডিবেঞ্চারও যে আম্বানিরা কেউ নিজেদের জন্য রাখেননিÑএটা একটি ডাহা মিথ্যা!

 

 

 

 

 

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০