পাস্তুরিত দুধ-সংক্রান্ত সম্প্রতি ট্যারিফ কমিশন প্রকাশিত প্রতিবেদনে মিল্ক ভিটার মুনাফার যে তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, তাতে স্পষ্ট হয় উচ্চ হারে মুনাফা করছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, প্রতি লিটার দুধ উৎপাদনে খরচ হয় ৫৪ টাকা, আর খুচরা দোকানির কাছে তা বিক্রি করা হচ্ছে ৬২ টাকা দরে। এ চিত্র আমাদের যেমন অবাক করে, তেমনি মনে এ প্রশ্নও জাগায় দুধের মতো প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এত উচ্চ হারে মুনাফা করবে কেন? বস্তুত মিল্ক ভিটা এ খাতে দেশের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান। তাদের মার্কেট শেয়ার অর্ধেকেরও বেশি। পাস্তুরিত দুধ উৎপাদনকারী আরও যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তারাও দাম নির্ধারণ করে এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। এ অবস্থায় স্বভাবতই আরেকটি প্রশ্ন ওঠে, মিল্ক ভিটা যদি উচ্চ হারে মুনাফা করা থেকে বেরিয়ে না আসে, তাহলে এ ধরনের দুধের দাম কমানো কি সহজ হবে?
উল্লেখ্য, খামারিদের কাছ থেকে মিল্ক ভিটা দুধ কেনে মাত্র ৩৪ টাকায়। এ থেকে আরও একটি বিষয় স্পষ্ট, প্রতি লিটার দুধ প্রক্রিয়াকরণে প্রতিষ্ঠানটির খরচ হচ্ছে প্রায় ২০ টাকা। এর প্রভাব যে দামে ব্যাপকভাবে পড়ছে, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। রাষ্ট্রায়ত্ত এ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের বক্তব্যে জানা যাচ্ছে, তাদের শ্রমিক ব্যয় বেশি; পাস্তুরিতকরণের যন্ত্রপাতি পুরোনো হওয়ায় কমে গেছে সেগুলোর দক্ষতা। এ কারণেও বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়। বাস্তবতা হলো, মজুরি বাবদ ব্যয় হ্রাস শিগগির সম্ভব না হলেও নতুন যন্ত্রপাতি স্থাপন করে দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রান্তিক উৎপাদন ব্যয় কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব। এটা করা গেলে মিলগেটে বর্তমানের চেয়ে কম দরে দুধ বিক্রি যেমন সম্ভব হবে, তেমনি প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে ইতিবাচক প্রভাব রাখা সম্ভব বাজারে। এজন্য উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মিল্ক ভিটায় বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
উৎপাদনকারী পর্যায়ে দুধের দাম বৃদ্ধির দাবিতে কিছুদিন আগে ধর্মঘট ডেকেছিলেন মিল্ক ভিটার খামারিরা। তাদের দাবি পূরণে অগ্রগতি কতটা হয়েছে, জানা নেই। তাদের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা উচিত এ কারণে যে, উৎপাদন-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন উপাদানের দাম বেড়েছে। যৌক্তিক দাম না পেলে তারা কিছুটা হলেও নিরুৎসাহিত হবেন। অপাস্তুরিত দুধের জোগান কমে গেলে তার প্রভাব পড়বে উৎপাদনে। তাতে আবার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন ভোক্তারা। এক্ষেত্রে একটি বিষয়ে আমরা জোর দিয়ে বলতে চাই, খামারিদের বঞ্চিত ও ভোক্তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান মুনাফা করবেÑএ নীতি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বস্তুত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের মালিক জনগণ। এমন প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় তাদের কল্যাণের বিষয়টিই বিবেচনায় রাখা উচিত সবার আগে। মিল্ক ভিটা কোনো লোকসানি প্রতিষ্ঠান নয়। এজন্য মুনাফা কিছুটা কম করলেও তাতে ব্যবস্থাপনাগত সমস্যা হবে না।
এটা অনেকের জানা, দেশে দুধ উৎপাদন তদারক করার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এজন্য দীর্ঘ দিন ধরে ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড গঠনের দাবি রয়েছে বিভিন্ন মহলের। এমন সুপারিশ রয়েছে ট্যারিফ কমিশন প্রকাশিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও। সম্প্রতি জাতীয় দুগ্ধ উৎপাদন নীতিমালার যে খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে, তাতেও এমন একটি প্রতিষ্ঠান গঠনের কথা উল্লেখ আছে। এটা খাতটি ঘিরে নীতিনির্ধারকদের সুবিবেচনারই বহিঃপ্রকাশ। আমরা মনে করি, এটির বাস্তবায়নও শিগগির করা দরকার। গুরুত্বপূর্ণ এ খাত দেখভালের মতো প্রতিষ্ঠান ও যথাযথ তদারকি থাকলে অনাকাক্সিক্ষতভাবে উদ্ভূত পরিস্থিতিগুলো দুধের বাজারে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারবে না। এতে মিল্ক ভিটা ছাড়াও অন্য যেসব প্রতিষ্ঠান আছে, তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা সহজ হবে। বস্তুত মানুষের মধ্যে পুষ্টিজ্ঞান যত বাড়বে, দুধের বাজারও ততো বড় হবে। এজন্য খাতটি ঘিরে থাকা চাই দূরদর্শী পরিকল্পনা।
Add Comment