নাজমুল হুসাইন: দেশে পাস্তুরিত দুধের সিংহভাগ বিক্রি করছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেড (মিল্ক ভিটা)। প্রতি লিটার দুধ উৎপাদনে মিল্ক ভিটার খরচ হচ্ছে প্রায় ৫৪ টাকা। আর খুচরা দোকানির কাছে তা বিক্রি হচ্ছে ৬২ টাকা দরে। এতে প্রতি লিটার দুধে ৮ টাকা লাভ করছে মিল্ক ভিটা।
সরকারি এই প্রতিষ্ঠানের বাইরে বাজারে বেসরকারি খাতেরও প্রায় ডজনখানেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তারাও বাজারে মিল্ক ভিটার সামঞ্জস্য রেখে দুধের দাম নির্ধারণ করে। কিন্তু খামারি পর্যায়ে তারা দুধ কেনে ২-৪ টাকা কম দামে। আর সেসব কোম্পানির প্রক্রিয়াজাত খরচও মিল্ক ভিটার তুলনায় অনেক কম। এ অবস্থায় এসব কোম্পানি প্রতি লিটার দুধে ১২ থেকে ১৫ টাকা মুনাফা করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দুধে মুনাফার এই তথ্য উঠে এসেছে সম্প্রতি বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন প্রকাশিত প্রতিবেদনে। ‘স্টাডি অন লিকুইড অ্যান্ড পাউডার মিল্ক প্রসপেক্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিল্ক ভিটার প্রতি লিটার দুধ উৎপাদন, মার্কেটিং, প্যাকেটিং থেকে শুরু করে বাজারজাত করা পর্যন্ত খরচ হয় ৫৩ টাকা ৬০ পয়সা। যার মধ্যে প্রান্তিক খামারিরা দুধের দাম পায় ৩৪ টাকা। এছাড়া বড় খরচগুলোর মধ্যে পাস্তুরিতকরণসহ মোড়কজাত খরচ হয় ৯ টাকা আর প্রতিষ্ঠানটির শ্রমিক খরচ ছয় টাকা ৩৩ পয়সা। এছাড়া মেশিন তত্ত্বাবধান, মেরামত, অবচয়, মিলে প্রতি লিটার দুধের মিলগেটে দাম পড়ছে ৫০ টাকা ৯৩ পয়সা। পরবর্তীতে তা অন্যান্য খরচ যুক্ত করে বাজারে সরবরাহ করতে বাকি খরচ ধরা হয়েছে।
এ বিষয়ে মিল্ক ভিটার চেয়ারম্যান শেখ নাদির হোসেন লিপু শেয়ার বিজকে বলেন, ‘দেশে সব কোম্পানিই একই দামে বাজারে দুধ বিক্রি করছে। মিল্ক ভিটার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত শ্রমিক রয়েছে। এছাড়া ৪০ বছরের পুরোনো মেশিনে চলছে প্রতিষ্ঠানটি। এতে পাস্তুরিত খরচ প্রতিদিন বাড়ছে। আর দুধ মূল উপকরণ হওয়ায় মিল্ক ভিটার বিপণনে ব্যয় বেশি।’
এদিকে মিল্ক ভিটা যেখানে খামারি পর্যায়ে দুধ ৩৪ টাকায় সংগ্রহ করছে সেখানে বেসরকারি কোম্পানি আরও ২ থেকে ৪ টাকা পর্যন্ত কম দামে দুধ কিনছে। এদিকে পুরোনো মেশিনে সরকারি এই কোম্পানির পাস্তুরিত খরচ বেশি। একইভাবে অতিরিক্ত শ্রমিক হওয়াতে তাদের খরচ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় অনেক বেশি। এছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কোম্পানিটি প্রতি ক্ষেত্রে বেশি ব্যয় করছে। ফলে মিল্ক ভিটার তুলনায় বেসরকারি কোম্পানিগুলো কম দামে দুধ ক্রয় করে অল্প খরচে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে প্রতি লিটার দুধে এ অধিক মুনাফা করছে।
‘বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অধিক মুনাফা করছে কি না’Ñ এমন প্রশ্নের জবারে মিল্ক ভিটার চেয়ারম্যান বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই বেসরকারি খাতের কোম্পানিগুলোর লাভ বেশি। কারণ মিল্ক ভিটা যেসব ক্ষেত্রে বেশি ব্যয় করছে, তা ওইসব কোম্পানির প্রয়োজন হয় না। এছাড়া তারা মিল্ক ভিটার তুলনায় অনেক কম খরচে দুধ সরবরাহ করতে পারছে।’
তবে অধিক মুনাফার বিষয়ে একমত নয় দেশের বেসরকারি খাতের সর্বোচ্চ পাস্তুরিত দুধ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল। প্রাণের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বলেন, ‘আমার মনে হয় সরকারি প্রতিষ্ঠানেরই খরচ কম হওয়ার কথা। তারা সরকারি বিভিন্ন সুযোগ পাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘বেসরকারি কোম্পানির আহামরি মুনাফা করার সুযোগ নেই। এখানে প্রতিটি কোম্পানির প্রচুর বিনিয়োগ রয়েছে। যার একটি প্রভাব পণ্যের দামে পড়ে। দুধ সংগ্রহে বেসরকারি কোম্পানির পরিবহন খরচ বেশি। আর বাজারে প্রতিযোগিতার জন্যও ব্যয় করতে হচ্ছে।’
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশীয় পাস্তুরিত দুধের বাজারে মিল্ক ভিটার মার্কেট শেয়ার ৫২ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। কোম্পানিটি প্রতিদিন সমবায় সমিতির বিভিন্ন খামারিদের কাছ ২ লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করে। এগুলো পরে পাস্তুরিত করে বাজারজাত করা হয়ে থাকে। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ভালো অবস্থানে রয়েছে প্রাণ, আড়ং ও ব্র্যাক।
শুধু ঢাকা মহানগরে প্রতিদিন প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার লিটার তরল দুধ বিক্রি হয়। এদিকে দেশের সর্বোচ্চ দুধ উৎপাদন হচ্ছে সিরাজগঞ্জ জেলায়। সেখানে শীত মৌসুমে ৩ লাখ ৯০ হাজার লিটার দুধ ও সাধারণ সময়ে দুই লাখ ৮৫ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হচ্ছে। যার মধ্যে সাধারণ সময় মিল্ক ভিটা প্রায় প্রতিদিন এক লাখ ২৫ হাজার লিটার, প্রাণ ১০ হাজার লিটার, ব্র্যাক ৫ হাজার লিটার ও অন্যান্য কোম্পানি দুই থেকে ৪ হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ করছে। বাজারে এসব কোম্পানি ছাড়া অ্যামো মিল্ক, বিক্রমপুর ডেইরি, আল্ট্রা শিলাইড ডেইরি, আফতাব ডেইরি, রংপুর ডেইরি দুধ ক্রয়-বিক্রয় করছে। তবে এদের দুধ সংগ্রহের পরিমাণ সামান্যই।
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুধের এ উপখাতগুলোতে নজরদারি বা উন্নয়নের জন্য কোনো ধরনের উন্নয়ন বোর্ড নেই। দুগ্ধ তৈরির পদ্ধতি পরীক্ষা, মান খতিয়ে দেখা, তাদের কার্যক্রম তদারকি, সেক্টরের উন্নয়ন, নীতি তৈরির মতো কাজগুলো ডেইরি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে হওয়া উচিত বলে তুলে ধরা হয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদনে এটি না থাকার কথা বলা হলেও সম্প্রতি চূড়ান্ত হয়েছে জাতীয় দুগ্ধ উৎপাদন নীতিমালার খসড়া। এতে ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড গঠনের কথা বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রচলিত যে পদ্ধতিতে দুধের বাজারজাত করা হয়ে থাকে তার থেকে বিভিন্ন মিষ্টির দোকান, গ্রাম ও শহরের ব্যক্তি পর্যায়ের ক্রেতা রয়েছে। মিষ্টির দোকানগুলো দেশে উৎপাদিত দুধের ৩৫ শতাংশই নিয়ে নেয়। বাকি ৬৫ শতাংশের ক্রেতা হলো ব্যক্তি পর্যায়ের। অন্য একটি গবেষণার বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, মিষ্টির দোকানে ২৭ শতাংশ, চায়ের দোকানে ১৪ শতাংশ এবং ব্যক্তি পর্যায়ে ৫৯ শতাংশ দুধ ব্যবহার হয়।
Add Comment