পাহাড়ধস আতঙ্ক:পর্যটক কমেছে তিন পার্বত্য জেলায়  

 

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: জীববৈচিত্র্য-ঝরনা-নদী-পাহাড় ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্য ঈদ মৌসুমে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তিন পার্বত্য জেলায় ছুটে যায় ভ্রমণপিপাসু মানুষ। আর তাদের আগমনে পর্যটনকেন্দ্রগুলো থাকে মুখরিত। সচল থাকে পর্যটন ব্যবসা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড় ধসের ঘটনায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ও নিরাপত্তা নিয়ে এক ধরনের ভীতি কাজ করছে পর্যটকদের মধ্যে। ফলে মন্দার কবলে পড়েছে পার্বত্যাঞ্চলে পর্যটন সংশ্লিষ্ট সব ধরনের ব্যবসা।

স্থানীয় বাণিজ্যিক সংগঠনগুলোর মতে, দেশীয় পর্যটকরাই পার্বত্যাঞ্চলের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। প্রতি বছর তিন পার্বত্য জেলায় প্রায় পাঁচ লাখের অধিক স্থানীয় পর্যটক আর হাজারখানেক বিদেশি পর্যটক আসেন। আর এসব পর্যটককে ঘিরে তিন পার্বত্য জেলায় গড়ে উঠেছে দুই শতাধিক আবাসিক হোটেল-মোটেল। অভ্যন্তরীণ যাতায়াতের জন্য রয়েছে এক হাজারের মতো মাঝারি যানবাহন। আর কয়েক হাজার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পরিবারগুলো পর্যটক আর্কষণে বিভিন্ন ধরনের উপকরণ তৈরি ও বিক্রয় করে থাকে। সব মিলিয়ে বছরে তিন পার্বত্য জেলায় পর্যটন খাতে প্রায় ৫০ কোটি টাকার লেনদেন হয়।

এ ব্যবসার বড় অংশই হয় ঈদ মৌসুমে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ভারি বর্ষণে রাঙামাটি জেলায় পাহাড় ধসে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় কয়েক সপ্তাহ। ফলে পর্যটকদের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও নিরাপত্তা নিয়ে ভীতির কারণে মন্দা দেখা দিয়েছে পার্বত্যাঞ্চলে পর্যটন সংশ্লিষ্ট সব ধরনের ব্যবসায়।

গত বছর ঈদের আগেই অধিকাংশ হোটেল-মোটেল বুকিং (আগাম ভাড়া) হয়ে গিয়েছিল। এ বছর ভ্রমণে আসার জন্য খুব কমসংখ্যক পর্যটকই বুকিং দিয়েছেন। গত ১৩ জুনের পাহাড়ধসের পর অনেকে বুকিং বাতিলও করেছেন। ফলে এবার লোকসানের আশঙ্কা করছেন জেলার হোটেল-মোটেল মালিকরা।

উল্লেখ্য, পার্বত্য রাঙামাটিতে পাহাড় ধসের ঘটনায় পুরো পার্বত্যাঞ্চল নিয়ে পর্যটকদের মধ্যে চলছে আতঙ্ক। গত সপ্তাহ থেকে রাঙামাটির সঙ্গে সীমিত পরিসরে হালকা যান চলাচল শুরু হলেও বড় আকারে যানবাহন চলাচল শুরু না হওয়ায় পর্যটকদের ভীতি এখনও রয়ে গেছে।

নিরাপত্তা ভীতির কারণে ঈদ ও ঈদ-পরবর্তী ভ্রমণ মৌসুমে বিভিন্ন হোটেল-মোটেলে যারা আগাম বুকিং দিয়েছেন, তা বাতিল করছেন। এরই মধ্যে বাতিল হয়েছে বান্দরবানে অর্ধ শতাধিক, রাঙামাটিতে প্রায় ১০০ ও খাগড়াছড়িতে অর্ধশতাধিক হোটেল-মোটেলের অধিকাংশ আগাম বুকিং।

তিন পার্বত্য জেলায় প্যাকেজ ট্যুর পরিচালনাকারী বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে রাঙামাটিতে পর্যটকদের আনাগোনা সবচেয়ে বেশি। স্বাভাবিক পর্যটন মৌসুমে এ জেলায় প্রতিদিন সাত-আট হাজার পর্যটক আসেন। ঈদ মৌসুমে এ সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। অতি বর্ষণে পাহাড় ধসের ঘটনা পুরো পরিস্থিতিই এবার বদলে দিয়েছে। ফলে ঈদে তিন পার্বত্য জেলায় ঘুরতে যেসব পর্যটক বুকিং দিয়েছিলেন, এরমধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশই তাদের ভ্রমণ বাতিল করেছেন।

গতকাল বুধবার বান্দরবানের নীলাচল, মেঘলা, শৈল প্রপাতসহ বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, পর্যটক কেন্দ্রগুলোয় অলস সময় কাটাচ্ছিলেন হোটেল কর্মচারীরা। পাশাপাশি পরিবহন চালক-শ্রমিকরা কাক্সিক্ষত যাত্রী না পেয়ে গন্তব্যে যাচ্ছেন হতাশা হয়ে। তারা বলছেন, অন্যান্য বছর ঈদের আগেই বিপুলসংখ্যক পর্যটক আসেন। কিন্তু এবার তেমনটা হয়নি। ফলে মুনাফার মৌসুমেও লোকসানের সম্মুখীন।

হিলসাইড রিসোর্টের ব্যবস্থাপক রয়েল বম শেয়ার বিজকে বলেন, এবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বান্দরবান জেলার হোটেল ব্যবসায় মন্দা চলছে। এখনও হোটেলেগুলোর  ৫০ শতাংশেরও বেশি কক্ষ খালি পড়ে আছে। গত বছরের তুলনায় সার্বিক লেনদেন কমেছে ৫০ শতাংশের বেশি। অথচ বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় ঈদ মৌসুমে পর্যটক বেশি আসে। আমাদের আয়ও হয় বেশি।

ট্যুরিস্ট জিপ গাড়ি শ্রমিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ কামাল বলেন, পর্যটকবাহী প্রায় তিনশ থেকে চারশ গাড়ি রয়েছে বান্দরবানে। এসব গাড়িতে কাজ করেন হাজারখানেক শ্রমিক। প্রতি ঈদে বাড়তি রোজগারও হয়। কিন্তু এবার কাক্সিক্ষত পর্যটক না আসায় শ্রমিক পরিবারগুলো অনেক কষ্টে পড়েছে।

এসব এলাকার কয়েকজন পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী শেয়ার বিজকে বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং নিরাপত্তাজনিত কোনো ধরনের সমস্যা নেই এখান। প্রশাসন এবং ব্যবসায়ীরাও পর্যটকদের বরণ করতে সবধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রয়েছে। কিন্তু পর্যটকের আশানুরূপ আগমন ঘটেনি। টানা তিন মাসের এ ক্ষতি পর্যটন ব্যবসায়ীরা কোনোভাবেই পুষিয়ে নিতে পারবে না।

বান্দরবানের হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বলেন, জেলা শহর ও শহরতলিতে ৫২টি হোটেল, মোটেল ও অবকাশযাপন কেন্দ্রে পাঁচ হাজার পর্যটকের ধারণক্ষমতা রয়েছে। গত বছর রোজার ঈদের পর এক সপ্তাহ হোটেল-মোটেলে কোনো কক্ষ খালি ছিল না। কিন্তু এ বছর তেমন বুকিং হয়নি। পর্যটকের উপস্থিতি কম থাকায় এবারে লোকসানে পড়তে হবে হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ীদের। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সৃষ্ট মন্দায় জমেনি এবার বান্দরবান জেলার পর্যটন ব্যবসায়।

বান্দরবান জেলা প্রশাসন ও হোটেল-মোটেল মালিকরা বলছেন, জেলায় পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটলেও পর্যটন স্পটগুলোর ক্ষতি হয়নি। পর্যটকরা নিরাপদে বান্দরবান আসতে পারবেন। জেলা প্রশাসক বলেন, বান্দরবানের সড়ক যোগাযোগসহ সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে। পর্যটকদের নিরাপদ এসে ফিরে যেতে সমস্যাই হবে না।

রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মানজারুল মান্নান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘অতি বর্ষণে পাহাড় ধসে রাঙামাটির পুরো এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থার মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। সীমিত আকারে ছোট যানবাহন চলাচল করলেও বড় আকারের যানবাহন চলাচল করতে আরও মাসখানেক সময় লাগবে। তবে পাহাড় ধসের পর থেকে রাঙামাটিতে পর্যটকদের ভ্রমণে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না-এ কথাটি সত্যি নয়। যোগাযোগ পরিস্থিতি ভালো না হওয়ায় পর্যটকদের উপস্থিতি তেমন নেই।’

 

 

 

Add Comment

Click here to post a comment

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০