পলাশ শরিফ: বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) সম্পদের পরিমাণ ১৩ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা। তবে এর মধ্যে প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার সম্পদের হিসাব পায়নি নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান। ওই সম্পদের যথাযথ নথিপত্রও দেখাতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। তাই নিরীক্ষকের পক্ষ থেকে পিজিসিবি’র প্রায় অর্ধেকের বেশি সম্পদের ‘অস্তিত্ব ও বাজারমূল্য’ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে।
কয়েক বছর ধরে আপত্তি উঠলেও গত ছয় বছরে ‘অস্তিত্বহীন’ সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১৫২ দশমিক ৩৬ শতাংশ বা পাঁচ হাজার ১৯০ কোটি টাকা বেড়েছে। রি-ভ্যালুয়েশনের মাধ্যমে এ মূল্য বাড়ানো হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিজিসিবি’র কোম্পানি সচিব মো. আশরাফ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সম্পদের হিসাব বের করতে একটি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ও একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুই বছরেও তারা কাজ শেষ করতে পারেনি। যে কারণে তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে সম্পদের তথ্য সংরক্ষণে সফটওয়্যার তৈরির জন্য পাইলট প্রকল্প নেওয়া হয়। ঢাকা উত্তর গ্রিড সার্কেলে এটি সফল হয়েছে। অন্য সার্কেলগুলোর জন্যও একই ধরনের প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। এসব প্রকল্প শেষ হলে সম্পদ-ইনভেনটরির সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে। তথ্য সংরক্ষিতও থাকবে। তবে সম্পদ নিয়ে কয়েক বছর ধরে চলমান জটিলতা কাটতে আরও সময় লাগবে।’
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় পিজিসিবি। সর্বশেষ ২০১৫-১৬ অর্থবছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে সম্পদের তালিকায় আট হাজার ৫৩৬ কোটি ৮১ লাখ ৩৬ হাজার টাকার স্থায়ী সম্পদ (নন-কারেন্ট অ্যাসেট) দেখিয়েছে। ওই তালিকায় পরিচালন মূলধন ছাড়া জমি, অফিস অবকাঠামো, যানবাহনসহ অন্যান্য সম্পদের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। স্থায়ী সম্পদের মূল্য আগের অর্থবছরের তুলনায় ১১৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা বেশি। একইভাবে চলতি সম্পদের (কারেন্ট অ্যাসেট) তালিকায় পরিমাণ ৮০ কোটি ৮২ লাখ ৫৪ হাজার টাকার চলতি সম্পদ দেখানো হয়েছে। সম্পদের ওই তালিকার সিংহভাগই বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) ও ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) কাছ থেকে পাওয়া।
তবে কাগজে থাকলেও নিরীক্ষাকালে ওই সম্পদের মধ্যে প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার সম্পদের নথিপত্র পায়নি দুই নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান এ কাশেম অ্যান্ড কোং ও এসএফ আহমেদ অ্যান্ড কোং। এ বিষয়ে নিরীক্ষকের আপত্তিতে বলা হয়েছে, ‘কোম্পানিটি আর্থিক বিবরণীতে স্থায়ী সম্পদ তালিকায় প্রপার্টি, প্ল্যান্ট অ্যান্ড ইক্যুইপমেন্ট (পিপিই) হিসেবে আট হাজার ৫৩৬ কোটি ৮১ লাখ টাকার সম্পদ দেখিয়েছে। তবে সম্পদের পরিমাণ উল্লেখ করলেও ওই সম্পদের বিষয়ে বিস্তারিত নথি রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। যে কারণে বিপিডিবি ও ডিপিডিসির কাছে থেকে পাওয়া সম্পদের বর্তমান অবস্থান ও বাজারমূল্য সম্পর্কে নিরীক্ষকদের কোনো তথ্য দিতে পারেনি। ওই সম্পদের বর্তমান মূল্য, সম্পদের অধিগ্রহণ বা অর্জনের সময়কাল ও ডিপ্রিসিয়েশন হার সম্পর্কেও কোনো তথ্য পিজিসিবির কাছেও নেই। এক্ষেত্রে পিজিসিবি বাংলাদেশ অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ডের (বিএএস) এ-সংক্রান্ত নির্দেশনাও পরিপালনে ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির বিএএসের ওই নির্দেশনা মেনে চলতে কোনো নীতিমালাও প্রণয়ন করেনি।
অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটির ইনভেনটরি নিয়েও আপত্তি উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৬০ কোটি ৮০ লাখ টাকার ইনভেনটরির সপক্ষে প্রয়োজনীয় নথিপত্র দেখাতে পারেনি, যা পিজিসিবির মোট ইনভেনটরির প্রায় ৭৫ শতাংশ। সেই হিসেবে, স্থায়ী সম্পদ ও ইনভেনটরি মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটির আট হাজার ৫৯৭ কোটি ৬১ লাখ টাকার সম্পদের অস্তিত্ব¡ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
পিজিসিবি’র সম্পদ বিষয়ে নিরীক্ষকের মন্তব্য সম্পর্কে ‘কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ও প্রকৌশলী সমন্বয়ে গঠিত একটি যৌথ উদ্যোগে স্থায়ী সম্পদ ও ইনভেনটরি বাস্তব যাচাই কাজ করা এবং কম্পিউটারভিত্তিক সফটওয়্যার তৈরি করে দেওয়ার জন্য নিয়োজিত করা হয়েছিল। নিয়োজিত কাজ সম্পাদনে যৌথ উদ্যোগটি ব্যর্থ হওয়ায় পিজিসিবি তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছে’Ñবলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত দুই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া পিজিসিবি’র ওই সম্পদ নিয়ে নিরীক্ষকের আপত্তি নতুন নয়। কোম্পানি হিসেবে পথচলা শুরুর পর থেকেই সম্পদের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন নিরীক্ষকরা। আর জটিলতার অবসান না হলে সেই সম্পদের পরিমাণ বাড়ছে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১০ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে তৎকালীন নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান একনাবীন তিন হাজার ৩৩৮ কোটি ৩২ লাখ টাকার স্থায়ী সম্পদ ও ৬৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকার ইনভেনটরি মিলিয়ে মোট তিন হাজার ৪০৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকার সম্পদের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। অথচ ‘অস্তিত্ত্বহীন’ সেই সম্পদের পরিমাণ ২০১৬ সালে এসে আট হাজার ৬১৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ বিতর্কিত সম্পদের পরিমাণ পাঁচ হাজার ২৭৯ কোটি ৩১ লাখ টাকা বেড়েছে।
তথ্যানুসন্ধানে মিলেছে, বিপিডিবি ও ডিপিডিসি’র কাছ থেকে পাওয়া সম্পদের যাবতীয় তথ্য না থাকা ও নিরীক্ষকের আপত্তির পরও ওই দুই সংস্থার দেওয়া হিসেবের ওপর ভর করেই স্থায়ী সম্পদের হিসাব দিচ্ছে পিজিসিবি। যে কারণে ফি বছর ওই সম্পদের বিপরীতে আপত্তি জানিয়ে যাচ্ছে নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান। এর জের ধরে ওই সম্পদের প্রকৃত অবস্থা যাচাই-বাছাই ও তথ্য সংরক্ষণের জন্য কম্পিউটারভিত্তিক সফটওয়্যার তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিল পিজিসিবি। তবে সেই উদ্যোগ ছয় বছরেও আলোর মুখ দেখেনি। যে কারণে প্রতিবছরই একই বিষয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিকে।
Add Comment