পিডিবির বিল বকেয়া পড়েছে ৫৯ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা!

ইসমাইল আলী: বিদ্যুৎ খাতে বকেয়া বিলের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। গত অর্থবছর শেষে সরকারি-বেসরকারি কেন্দ্র ও ভারত থেকে আমদানিকৃত বিদ্যুৎ বিল বকেয়া ছিল ২১ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসেই বকেয়া বাড়ে ১৫ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা। এতে বাধ্য হয়ে বন্ডে বকেয়া বিলের কিছুটা পরিশোধ করে সরকার। পাশাপাশি ভর্তুকিও ছাড় করা হয়।

যদিও চাহিদার তুলনায় অর্থ মন্ত্রণালয় ভর্তুকি দিচ্ছে অনেক কম। ফলে বকেয়ার পরিমাণ না কমে আরও বেড়ে গেছে। গত জানুয়ারি শেষে বকেয়া বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৯ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ চার মাসে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) বকেয়া বেড়েছে ২২ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা। বকেয়া বিল নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে পিডিবি। তাই জরুরি ভিত্তিতে চলতি অর্থবছরের জন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখা ভর্তুকির অবশিষ্ট ১৭ হাজার ৭০১ কোটি টাকা ছাড় করতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

গত ৬ মার্চ পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলোর স্থানীয় ঋণের বিপরীতে ১০ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা বন্ডের মাধ্যমে পরিশোধের পরও ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি এবং আদানিসহ ভারত থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ মোট অপরিশোধিত বিলের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ৭০৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এছাড়াও সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি ও দেশীয় আমদানি নির্ভর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানির ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত অপরিশোধিত বিলের পরিমাণ ১৬ হাজার ৭৯৯ কোটি ৮৩ লাখ টাকা।

রমজান শুরুর আগে পাঠানো এ চিঠিতে আরও বলা হয়, আসন্ন পবিত্র রমজান, সেচ ও গ্রীষ্ম মৌসুমে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্যে জরুরি ভিত্তিতে অপরিশোধিত বিল পরিশোধের জন্য ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ভর্তুকির অবশিষ্ট অর্থ ১৭ হাজার ৭০১ কোটি টাকা ছাড় করা প্রয়োজন। এর মধ্যে ভর্তুকি বাবদ চলতি মাসে চার হাজার কোটি টাকা, এপ্রিলে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা, মে মাসে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা এবং জুনে চার হাজার ৭০১ কোটি টাকা ছাড়ের প্রয়োজন হবে।

প্রসঙ্গত, চলতি অর্থবছর বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। তবে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অর্থ মন্ত্রণালয় ছাড় করেছে অর্ধেকেরও কম; তথা ১৭ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা। এখনও ভর্তুকির ১৭ হাজার ৭০১ কোটি টাকা ছাড় করা বাকি রয়েছে। এ অর্থই ছাড় করতে অনুরোধ করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। যদিও চলতি অর্থবছরের ভর্তুকির বেশিরভাগ অংশই গত অর্থবছরের ঘাটতি পূরণে ব্যয় করবে পিডিবি। ফলে আগামীতে বিদ্যুৎ খাতের ঘাটতি আরও বৃদ্ধি পাবে।

সূত্রমতে, ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে বিদ্যুতের ভর্তুকি ছাড়ে বিলম্ব শুরু করে অর্থ মন্ত্রণালয়। সরকারের রাজস্ব আয়ে মন্দা ও বাজেট ঘাটতির কারণে ভর্তুকি দেয়া হয় প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এর প্রভাব পড়ে পরের অর্থবছর। এভাবে ক্রমেই বকেয়া বেড়ে চলেছে। ২০২০-২১ অর্থবছর পিডিবির ভর্তুকি চাহিদা ছিল ১১ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় বরাদ্দ দিয়েছিল আট হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। এতে ওই অর্থবছরের ঘাটতি ভর্তুকি ২০২১-২২ অর্থবছর পরিশোধ করা হয়।

আবার ২০২১-২২ অর্থবছর পিডিবির ভর্তুকি চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় ২৯ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় বরাদ্দ দেয় ১১ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা। এতে ওই অর্থবছরের ভর্তুকি আবারও জমে যায়, যা ২০২২-২৩ অর্থবছর অর্থবছর পূরণ করা হয়। আবার ২০২২-২৩

অর্থবছর ভর্তুকি চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় ৪২ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা। অথচ এ খাতে বরাদ্দ ছিল ২৭ হাজার কোটি টাকা। ফলে আগের অর্থবছরের ঘাটতি পূরণের পর গত অর্থবছর চাহিদার মাত্র সাত হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা পূরণ করা যায়।

বকেয়া ভর্তুকি এই চেইন অ্যাফেক্ট পড়ে চলতি অর্থবছর। গত জুন শেষে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বকেয়া জমে যায় ৩৬ হাজার ৩৪১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বন্ডে পরিশোধ করা হয়েছে ১০ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ বন্ডে পরিশোধের পরও গত অর্থবছরের বকেয়া ভর্তুকি ছিল ২৫ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা। ফলে চলতি অর্থবছর বরাদ্দকৃত ভর্তুকি দিয়ে এখনও গত অর্থবছরের ঘাটতি পূরণ চলছে।

এদিকে চলতি অর্থবছর ৩৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দরকার হবে। তবে বরাদ্দকৃত অর্থ দিয়ে ১০ হাজার কোটি টাকারও কম পূরণ করা যাবে। ফলে চলতি অর্থবছর শেষে বকেয়া ভর্তুকি ২৯ হাজার কোটি টাকার মতো দাঁড়াবে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। যদিও এ বিষয়ে কেউ আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। তবে পিডিবি ও বিদ্যুৎ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ভর্তুকি ছাড় দ্রুত করা ও বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য নিয়মিতই অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। তবে উল্লেখযোগ্য কিছু অগ্রগতি হয়নি। এতে সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল জমে গেছে। ফলে সার্বিকভাবে বিদ্যুৎ খাত বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে আছে।

উল্লেখ্য, চলতি মাসের জন্য চার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি ছাড়ের চিঠি দিলেও তার থেকে ভারতের আদানি পাওয়ার (ঝাড়খণ্ড) লিমিটেডের পাওনা পরিশোধ করতে হবে দেড় হাজার কোটি টাকা। আর দেশীয় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা আমদানির অপরিশোধিত বিল পরিশোধের জন্য দিতে হবে দেড় হাজার কোটি টাকা। এ অর্থ দ্রুত পরিশোধ না করলে রমজান ও গ্রীষ্মে লোডশেডিং চরম আকার ধারণ করবে। তাই তিন হাজার কোটি টাকা জরুরি ভিত্তিতে ভর্তুকি হিসেবে ছাড়ের জন্য চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০