ইসমাইল আলী: গত বছরের শেষ দিক থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে ঊর্ধ্বমুখী গ্যাসের দাম। এতে বাধ্য হয়েই তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আমদানি কমায় সরকার। ফলে বসিয়ে রাখতে হচ্ছে বেশকিছু গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র। এতে তেলচালিত কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হয়েছে। যদিও জ্বালানি তেলের দামও বেড়েছে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। এ কারণে চলতি অর্থবছর বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়তে যাচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।
সূত্রমতে, লোকসানের বোঝা কমাতে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা চলছে। চলতি শীতেই তা কার্যকর করার কথা থাকলেও আপাতত প্রক্রিয়াটি পিছিয়ে গেছে। ফলে চলতি (২০২১-২২) অর্থবছর পিডিবির লোকসান প্রাক্কলন করা হয়েছে ২৬ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা। যদিও গত (২০২০-২১) অর্থবছর এ লোকসানের পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি অর্থবছর পিডিবির লোকসান দ্বিগুণ ছাড়িয়ে যাবে।
সম্প্রতি পিডিবির বোর্ড সভায় এ তথ্য উত্থাপন করা হয়। এতে জানানো হয়, চলতি অর্থবছরের সংশোধিত ও আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ১০ জানুয়ারির মধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে এবং ১৭ জানুয়ারির মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হবে। এক্ষেত্রে চলতি অর্থবছর ভর্তুকির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৪ হাজার ২৪৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।
এদিকে আগামী (২০২২-২৩) অর্থবছরের জন্য ২৭ হাজার ৭১৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা লোকসান প্রাক্কলন করেছে পিডিবি। আর ভর্তুকির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২২ হাজার ৭৮ কোটি ১৯ লাখ টাকা। শিগগিরই চলতি ও আগামী অর্থবছরের উল্লিখিত ভর্তুকিসহ বাজেট বরাদ্দ চেয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের মাধ্যমে চিঠি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
পিডিবির বোর্ড সভায় উত্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০-২১ অর্থবছর দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ২১ হাজার ৭৮০ মেগাওয়াট। চলতি অর্থবছর তা ২৩ হাজার ১২২ ও আগামী অর্থবছর ২৬ হাজার ৬২২ মেগাওয়াট নির্ধারণ করা হয়েছে। আর গত অর্থবছর নিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল সাত হাজার ৮৬৫ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা। চলতি অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়াবে আট হাজার ৪৯৬ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৯ হাজার ১৭৯ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা।
এদিকে গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় ছিল কিলোওয়াটপ্রতি পাঁচ টাকা ৪৯ পয়সা। চলতি অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে সাত টাকা ৬৯ পয়সা। আর বিদ্যুতের গড় বাল্ক (পাইকারি) বিক্রয় মূল্য দাঁড়িয়েছে কিলোওয়াটপ্রতি পাঁচ টাকা ১২ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রিতে পিডিবির লোকসান হচ্ছে দুই টাকা ৫৭ পয়সা। গত অর্থবছর এ লোকসান ছিল ৬৩ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি ইউনিটে লোকসান বেড়ে গেছে চারগুণের বেশি।
তথ্যমতে, বিদ্যুৎ উৎপাদন, বেসরকারি খাত কেনা, ভারত থেকে আমদানি ও অন্যান্য খাত মিলিয়ে পিডিবির চলতি অর্থবছর সম্ভাব্য মোট ব্যয় দাঁড়াবে ৬৯ হাজার ৬৩২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। আর বিদ্যুৎ বিক্রি ও অন্যান্য খাত মিলিয়ে সংস্থাটির মোট আয় দাঁড়াবে ৪৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ফলে পিডিবির মোট লোকসান দাঁড়াবে ২৬ হাজার ৫৩২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। আর সরকার থেকে ভর্তুকি পাবে ২৪ হাজার ২৪৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।
এদিকে গত অর্থবছর পিডিবির লোকসান ছিল ১১ হাজার ৬৪৮ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। আর ভর্তুকি দেয়া হয় ১১ হাজার ৭৭৭ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এছাড়া আগামী অর্থবছর পিডিবির লোকসান প্রাক্কলন করা হয়েছে ২৭ হাজার ৭১৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এজন্য ভর্তুকি প্রাক্কলন করা হয়েছে ২২ হাজার ৭৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।
চলতি অর্থছর লোকসান অস্বাভাবিক বৃদ্ধির দুটি কারণ বোর্ড সভায় তুলে ধরা হয়। একটি হলো, বেসরকারি খাতের আইপিপি ও রেন্টাল এবং পিডিবির আওতাধীন কোম্পানিগুলো থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনে বিতরণকারী কোম্পানি বা সংস্থাগুলোকে কম মূল্যে সরবরাহ করা। দ্বিতীয়টি হলো বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার পরিবর্তনের ফলে টাকার অবমূল্যায়নজনিত ক্ষতি।
এদিকে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি না করায় লোকসানের ঘাটতি মেটাতে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ানোকেই একমাত্র উপায় হিসেবে তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে। তবে লোকসানের বোঝা কমাতে পিডিবির স্থির ব্যয় কমানোর ওপর ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এর উপায় হিসেবে সভায় জানানো হয়, চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের স্থাপিত ক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় পিডিবির স্থির ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষেত্রে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে তা বন্ধের মাধ্যমে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট হ্রাস করা যেতে পারে। এতে লোকসানের চাপ কমে আসবে।