নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশে বর্তমানে রাজনীতি পুঁজিপতিদের সম্পদ সংহতকরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহƒত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে ঋণখেলাপি হওয়া একটি বিজনেস মডেলে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক সংযোগ ব্যবহার করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সম্পদশালী হওয়ার এক কৌশল অবলম্বন করে চলেছেন একশ্রেণির পুঁজিপতি।
রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে গতকাল অর্থনীতিবিদদের সংগঠন সাউদ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) আয়োজিত বার্ষিক ইকোনমিস্ট সম্মেলনের একটি অধিবেশনে তিনি এ মন্তব্য করেন। অধিবেশনের মূল বিষয়বস্তু ছিল দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা শক্তিশালী হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত ঘটানো।
এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে গিয়ে রেহমান সোবহান বলেন, এই ভূখণ্ডে স্বাধীনতার আগে থেকেই এক দলের আধিপত্যবাদী রাজনৈতিক অবস্থানের অস্তিত্ব ছিল। ১৯৫৫ সালের দিকে যখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তানের সরকার গঠিত হয়েছিল, তখন থেকেই আওয়ামী লীগ এককভাবে প্রভাবশালী দল ছিল। পরবর্তী সময়ে মওলানা ভাসানী ন্যাপ গঠন করা হলেও সেটি রাজনৈতিক অঙ্গনে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। এমনকি স্বাধীনতার পরও আওয়ামী লীগের সেই শক্তিশালী অবস্থান বজায় ছিল। তিনি বলেন, বাংলাদেশে সামরিক শাসনামলেও একক দলের আধিপত্য বিরাজমান ছিল। জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময়েও সেটি ছিল। এই অবস্থার পরিবর্তন হয় ১৯৯০ সালের পরে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন হওয়ার পর থেকে। তখন থেকে রাজনীতিতে এক দলের পরিবর্তে দুই দলের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়, যা এখনও বলবৎ আছে।
তিনি বলেন, ডমিনেন্ট পলিটিক্যাল সিস্টেম বলতে যা বোঝায়, সেটি বাংলাদেশে হয়নি। এমন উদাহরণ পাওয়া যায় সিঙ্গাপুরে। দেশটিতে একক দলের আধিপত্যবাদী শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও সেখানে প্রতিষ্ঠান অনেক শক্তিশালী এবং সেগুলো রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত। কিন্তু বাংলাদেশে উল্টো চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। এখানে প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হওয়ার পরিবর্তে উল্টো প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও দুর্বল করে তোলা হচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেন, উন্নত দেশের লক্ষ্য পূরণ করতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।
জিয়াউর রহমানের সময় রাজনীতির সঙ্গে পুঁজিপতিদের সংযোগ ঘটে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওই সময় অনেক ব্যবসায়ী রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে নানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। বিশেষ করে অনেক তৈরি পোশাক ব্যবসায়ী রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বড় ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন এবং ওইসব পুঁজিপতির রাজনীতির সঙ্গে একটি সংযোগ গড়ে ওঠে। সেই ব্যবস্থা এখনও চলমান রয়েছে। এখনও ব্যবসায়ীরা সম্পদশালী হওয়ার জন্য রাজনীতিকে ব্যবহার করছেন।
আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) সিনিয়র গবেষণা ফেলো ড. মির্জা এম হাসান। তিনি বলেন, দেশে একটি ডমিনেন্ট পলিটিক্যাল সিস্টেম (ডিপিএস) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর ফলে অন্য দলগুলো রাজনীতি ও গণতন্ত্র চর্চায় জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছে না। তিনি উল্লেখ করেন, আগামী পাঁচ বছর সরকারি দল নানাভাবে বিএনপির পেছনে লেগে থাকবে তাদের মধ্যে ভাঙন ধরানোর জন্য। এ কাজে যদি তারা সফল হয়, তাহলে দেশে কার্যকরভাবে একদলের আধিপত্যবাদী শাসন ব্যবস্থা চালু হয়ে যাবে।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক রওনক জাহান। তিনি বলেন, যে রাজনৈতিক দল ক্ষমায় বসেছে, তারা কি রাজনৈতিক দলের ওপর ভর করে ক্ষমতায় আসছে, নাকি রাষ্ট্র কাঠামোকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় বসছে, সে আলোচনা তোলার সময় এসেছে। তিনি উল্লেখ করেন, রাজনৈতিক ক্ষমতাকে বৈধতা দেয়ার জন্য সামরিক শাসকরাও রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন।
এসব রাজনৈতিক দল এক ধরনের কসমেটিক্স হিসেবে ব্যবহƒত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সবাই ক্ষমতায় থেকেছে রাষ্ট্রকাঠামোকে ব্যবহার করে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, বাংলাদেশে একদলীয় আধিপত্যবাদী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ এক দলের শাসন ব্যবস্থা ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে থাকে। কিন্তু কোনো ব্যক্তিই অমর নয়। ফলে এখন যে ব্যক্তি দলীয় প্রধান হিসেবে আছেন, তার মৃত্যুর পর উপযুক্ত উত্তরাধিকার না থাকলে একদলীয় আধিপত্য আর টিকবে না। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, শেখ হাসিনা ছাড়া বর্তমান আওয়ামী লীগ ‘জিরো’। শেখ হাসিনা না থাকলে আওয়ামী লীগের কোনো শক্তিই থাকবে না। ফলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একদলীয় আধিপত্য দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সুযোগ নেই।