সাইফুজ্জামান সুমন: পুঁজিবাজারে সূচকের বড় ধরনের দরপতনের মধ্যে দিয়ে চলছে লেনদেন। পুঁজিবাজার যেন কোনোভাবেই ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটি একচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নানা নির্দেশনার পরেও বাজার পতন ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সূচকের বড় দরপতনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন বিনিয়োগকারীরা। এতে বিনিয়োগকারীদের ধীরে ধীরে শেয়ার বিক্রির হিড়িক পড়ে। বিক্রির চাপে বাজার আরও অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে। পুঁজি হারিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়ছেন বিনিয়োগকারীরা।
বাজার ঘুরে একাধিক বিনিয়োগকারীর সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, বর্তমান বাজার পরিস্থিতি অনিশ্চয়তায় মধ্যে রয়েছে। গত প্রায় আট মাসের দরপতনে প্রায় ৪০ শতাংশ পুঁজি হারিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। আবার নতুন করে দরপতনে পুঁজি নিয়ে শঙ্কায় ভুগছে বিনিয়োগকারীরা। বর্তমান পুঁজিবাজারে একের পর এক গুজব চলছে। এভাবে গুজব চলতে থাকলে বিনিয়োগকারীদের নিঃস্ব হতে বেশি দিন লাগবে না।
বিএসইসি পুঁজিবাজার পতন ঠেকাতে চলতি মাসে শেয়ারদর কমার সীমা সর্বোচ্চ দুই শতাংশ করা হয়। স্থিতিকরণ তহবিল থেকে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের জন্য সরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। এতেও বাজার পতন ঠেকানো যাচ্ছিল না।
বিভিন্ন উৎস থেকে তহবিল সংগ্রহের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছ থেকেই বড় অঙ্কের অর্থ নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে বর্তমানে ঋণ ও আমানত হিসেবে নেয়া এ অর্থ পরিশোধ করতে গিয়ে বেশ চাপে পড়েছে আইসিবি। আইসিবি ঋণ সমন্বয় করার জন্য সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজারে শেয়ারও বিক্রি করতে হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিকে। এতে কিছুটা ধাক্কা লাগে বাজার পতনে। বিক্রয় চাপ ঠেকাতে সর্বশেষ চলতি মাসে মার্জিন ঋণের বিপরীতে বিনিয়োগ সীমা ১:১ শতাংশ করে নির্দেশনা দেয় সিকিউরিটি একচেঞ্জ কমিশন। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীদের ১০০ টাকা বিনিয়োগ থাকলে ১০০ টাকা মার্জিন ঋণ সুবিধা পাবে। পতন রোধে এতেও কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখা যায়নি।
পুঁজিবাজারকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে ব্যাংকগুলো আইসিবির মাধ্যমে পুঁজিবাজারে যে বিনিয়োগ করবে, সেটাকে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগসীমার (এক্সপোজার লিমিট) বাইরে রাখা হবে, এমন নির্দেশ দেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। পুঁজিবাজার চাঙা করতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য আইসিবিকে দেয়া ১৫৩ কোটি টাকার যে তহবিলের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল, সেটির মেয়াদ বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তহবিলের আকারও বাড়িয়ে ৩০০ কোটি টাকা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এসব নির্দেশনার পরও সূচকের নিন্মমুখী প্রবণতা লক্ষ করা গেছে।
এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, শুধু নির্দেশনা দিলেই তো হবে না, এর বাস্তবায়ন হওয়াটা জরুরি। পুঁজিবাজারে ফান্ড ইন করতে হবে আগে। যদি ফান্ড ইন না হয়, তবে বাজার ডিমান্ড বাড়বে না। এরই মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পুঁজি মার খেয়েছে। কারসাজি চক্র কিছু জাংক শেয়ার উচ্চ দামে ধরিয়ে দিয়ে সটকে পড়েছেন। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের পক্ষে বাজার তোলা আর সম্ভব নয়। বাজার যদি ওঠাতে হয় তবে প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের প্রত্যক্ষ ভ‚মিকা থাকতে হবে। ব্যাংকগুলোর এক্সপোজার লিমিট বাইরে রাখা হয়েছে, ব্যাংকের টাকাও আছে, এখন তারা যদি বিনিয়োগ না করে তা হলে তো বাজার বাড়বে না।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া ইস্যু যেতে না যেতেই শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে দেউলিয়াত্ব দেশের পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। শ্রীলঙ্কার মতোই বাংলাদেশের অর্থনীতি দেউলিয়া হতে পারে, এমন গুজব ছড়িয়ে পড়েছে পুঁজিবাজারে। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন।
এদিকে প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার ধরা পড়ায় পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার সঙ্গে পুঁজিবাজারে কারসাজিতে জড়িতরা ভয় ও আতঙ্কে রয়েছেন। তাদের অনেকে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। তাতে বাজারে প্যানিক সেল বেড়েছে। আর এ ইস্যুগুলোকে কাজে লাগিয়ে কারসাজি চক্র কম দামে শেয়ার কিনছে। আর বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন। ফলে পুঁজিবাজারের পতন ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। এর প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য ও জাহাজ ভাড়া বেড়ে যায়। এতে আমদানি খরচ অনেকটা বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে যে হারে আমদানি বাড়ছে, সে হারে রপ্তানি না বাড়ার কারণে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যায়। সম্প্রতি দেশের বাণিজ্য ঘাটতিতে রেকর্ড তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি বেড়ে গেছে খোলা বাজারে ডলারের দাম। চরম ডলার সংকট দেখা দিয়েছে ব্যাংক খাতে। এলসি মূল্য পরিশোধ করতেও হিমশিম খাচ্ছে কিছু কিছু ব্যাংক। বিশেষ করে ছোট ব্যাংকগুলোয় সবচেয়ে বেশি ডলার সংকট দেখা দেয়।
বিভিন্ন কারণে এসব ব্যাংকের রপ্তানি বাণিজ্যের অগ্রগতি ঘটেনি। আমদানিতেও অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় তৃতীয় প্রজšে§র ব্যাংকগুলো পিছিয়ে। ডলার সংকটের কারণে ঋণপত্র খুলতে বিড়ম্বনায় পড়ছে ব্যাংকগুলো। তবে যেসব ব্যাংকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেশি তাদের কাছে পর্যাপ্ত ডলার আছে। এর বিপরীতে পর্যাপ্ত রেমিট্যান্স না আসায় ডলার সংকটে পড়েছে তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলো। আর বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন। ফলে পুঁজিবাজারের পতন ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। এর প্রভাব পুঁজিবাজারে পড়েছে, যার ফলে বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন। এজন্য পুঁজিবাজারের পতন ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না।