আতাউর রহমান:দেশের পুঁজিবাজারে প্রতিনিয়ত হয় শেয়ার কারসাজি। সেই সঙ্গে তালিকাভুক্ত কোম্পানি, বাজার মধ্যস্থতাকারী এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে মাঝেমধ্যেই অনিয়ম, আইন ভঙ্গ, জালিয়াতি ও দুর্নীতিসহ নানা বিষয় খুঁজে পায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। যে কারণে সেসব বিষয় তদন্তে প্রথমে কমিটি গঠন করা হয় এবং সার্বিক প্রমাণাদিসহ অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি দিয়ে থাকে কমিশন। সেক্ষেত্রে প্রথমে শেয়ার কারসাজিকারী এবং অপরাধের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শাস্তির বিষয় কমিশন সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরে প্রেস বিজ্ঞপ্তি ও এনফোর্সমেন্ট তথ্য প্রকাশ করে বিএসইসি। শুরু থেকেই এমনটি হয়ে আসছিল।
কিন্তু কয়েক বছর ধরে প্রথমে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে শাস্তির তথ্য দেয়া বন্ধ করে কমিশন। এরপর চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত এনফোর্সমেন্ট তথ্যে প্রকাশ করলেও ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত আর কোনো মাসের তথ্য প্রকাশ করেনি বিএসইসি। অথচ এই সময়ে শেয়ার কারাসজি, তালিকাভুক্ত কোম্পানির অনিয়ম ও আইন লঙ্ঘন এবং বাজারসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বেশ কিছু বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অপরাধের জন্য কমিশন শাস্তি দেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। তবে এসব তথ্য বিএসইসি থেকে প্রকাশ করা হয়নি। ফলে অপরাধীরা দেশের পুঁজিবাজারে অচেনা থেকে যাবে এবং পরবর্তীকালে কারসাজি করতে তাদের কোনো অসুবিধা হবে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সেই সঙ্গে বিএসইসির এমন সিদ্ধান্ত বা কার্যক্রম বাজারে অপরাধীদের তথ্য গোপনের জন্য, নাকি তাদের শাস্তি দিতে কারচুপি করছে বলে আশঙ্কা করছে অনেকে।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বিএসইসির এনফোর্সমেন্টের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ফেব্রুয়ারি থেকে বিএসইসির মাসিক এনফোর্সমেন্ট তথ্যে কোনো ধরনের অর্থদণ্ড বা শাস্তির তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। শুধু নন-কমপ্লায়েন্স বা ছোট অনিয়মের জন্য সতর্কীকরণের নির্দেশনাগুলোর তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। তবে জানুয়ারিতে একটি কোম্পানিতে অনিয়ম ও আইন লঙ্ঘনের জন্য উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের একজনকে বাজারে মিথ্যা তথ্য বা গুজব ছড়ানোর জন্য এবং একাধিক ব্যক্তিকে শেয়ারে কারসাজির জন্য করা শাস্তির তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু এর পর থেকে অনিয়ম ও কারসাজির বিপরীতে সতর্কীকরণের নির্দেশনাটি প্রকাশ করলেও অপরাধের শাস্তির বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয় না।
তথ্যমতে, গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত এনফোর্সমেন্ট অ্যাকশনের যে রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে তাতে দেখা যায়, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত এনফোর্সমেন্ট অ্যাকশনে ছিল না কোনো ধরনের অর্থদণ্ডের বিষয়। এর মধ্যে গত নভেম্বরে মোট ৫২টি এনফোর্সমেন্ট অ্যাকশন নিয়েছে বিএসইসি। তার মধ্যে ৪৪টি প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক করার পাশাপাশি সাত ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক দণ্ড দেয়া হয়েছে। ডিসেম্বরে ৪৩টি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে সতর্ক করার পাশাপাশি একটি প্রতিষ্ঠান ও এক ব্যক্তিকে অর্থদণ্ড দেয়া হয়।
এদিকে জানুয়ারিতে মোট ১০৭টি এনফোর্সমেন্ট অ্যাকশন নেয় কমিশন। এর মধ্যে ৯টি অ্যাকশন ছিল অর্থদণ্ড ও শাস্তির। একটি হচ্ছে অ্যাপোলো ইস্পাতের উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের বিরুদ্ধে, একটি বাজারে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো এবং আরেকটি হচ্ছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের শেয়ার নিয়ে কারসাজি করা। এদিকে ফেব্রুয়ারিতে সাতটি, মার্চে ১২টি, এপ্রিলে ২৫টি, মে মাসে ৩৬টি, জুনে ২৩টি এবং জুলাইয়ে ২২টি এনফোর্সমেন্ট অ্যাকশনের তথ্য প্রকাশ করেছে, যার সবই শুধু নন-কমপ্লায়েন্স বা ছোট অনিয়মের জন্য সতর্কীকরণের নির্দেশনা। এ সময়ে কোনো অর্থদণ্ড বা শাস্তির তথ্য প্রকাশ করেনি বিএসইসি।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজার কারসাজি কখনোই বন্ধ হবে না। সেই সঙ্গে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো অনিয়ম ও আইন লঙ্ঘন করেই চলেছে। কিন্তু দেখার বিষয় এই কারসাজি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রকের কঠোর অবস্থান কী এবং অপরাধীদের বাজারে চিহ্নিত করা হচ্ছে কি না, যাতে ব্যক্তি হোক বা কোম্পানি, যারা অপরাধী তাদের যেন সবাই এড়িয়ে চলতে পারে। তাদের যেন পুঁজিবাজারে ঠাঁই না হয়। কিন্তু বিএসইসি যদি তাদের তথ্য প্রকাশ করা বন্ধ করে দেয় তবে তারা কারসাজি ও অপরাধের আরও সুযোগ পাবে। আর তাদের কেউ না চেনার ফলে বারবার অন্যরা ফাঁদে পড়বে। তাই বিএসইসির উচিত অপরাধীদের বাজারে চিহ্নিত করিয়ে দেয়া এবং বাজার থেকে তাদের বের করে দেয়া। ফলে কেউ যেন তাদের প্রশ্রয় না দেয়। তবে বিএসইসি যদি তথ্য লুকিয়ে রাখে, তাহলে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নিয়ে সবাই প্রশ্ন তুলবে। সেই সঙ্গে অপরাধীদের তথ্য লুকানোর পেছনে বিএসইসির কোনো স্বার্থ আছে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ তৈরি হবে বলে জানান তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. রেজাউল করিম শেয়ার বিজকে বলেন, যেসব তথ্য প্রকাশ করতে হয়, সেগুলো কমিশন সভা শেষে প্রেস বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ হয়। বাকি যেসব তথ্য থাকে সেগুলো বিভাগের বার্ষিক প্রতিবেদনে থাকে। তবে এনফোর্সমেন্ট অ্যাকশনের ক্ষেত্রে আমাদের কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। সেক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে তথ্য প্রকাশ করা হলে অনেক সময় তিনি বা তারা মিডিয়া ট্রায়ালের সম্মুখীন হয়।
তিনি আরও বলেন, এনফোর্সমেন্টের প্রথম পর্যায়ে দোষী সাব্যস্ত করে জরিমানা করা হলে আপিল করার সুযোগ থাকে। পরে অনেক সময় আপিলের পর আর দোষী থাকেন না। আর কোন তথ্য প্রকাশ হবে বা হবে না, তা বিএসইসির নীতিগত বিষয়। তবে তথ্য প্রকাশে বিএসইসি সব সময় খুবই আন্তরিক। তাই ভবিষতে আরও বেশি তথ্য কীভাবে প্রকাশ করা যায়, সে বিষয়ে কমিশনের চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। এছাড়া বর্তমানে কোনো অ্যাকশন নেয়া হলে তা মাসভিত্তিক প্রকাশ করা হয়। এক্ষেত্রে কাউকে অর্থদণ্ড দেয়া হলে সেখানে সে তথ্য দেয়া হবে বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, ২০২০ ও ২০২১ সালে নানা শেয়ারে কারসাজির ফলে অন্য কারসাজিকারীদের সঙ্গে আবুল খায়ের হিরু, সাইফ উল্লাহসহ বড় বিনিয়োগকারীদের অর্থদণ্ড দেয়া হয়। এর মধ্যে হিরুর নামটি সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে। তবে বিএসইসির আর্থিক দণ্ডের পরিমাণ নিয়ে পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্টদের মাঝে সমালোচনা তৈরি হয়।