নিয়ন্ত্রক সংস্থার চিঠিতে সাড়া নেই

পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে আস্থার সংকট দেখছে ব্যাংক      

শেখ আবু তালেব: ব্যাংকগুলোর কাছে পর্যাপ্ত তারল্য রয়েছে। আবার সুযোগও রয়েছে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে পুঁজিবাজারে তারল্য বাড়াতে চায় বিএসইসি। এজন্য বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে দফায় দফায় তাগাদা দিয়েও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাংকাররা বলছেন, নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তগুলো খুব দ্রুত পরিবর্তন হয় পুাঁজবাজারে। আর দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের শেয়ারের সংখ্যাও কম। তাই অর্থ নয়, আস্থার সংকট থেকে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে না ব্যাংক খাত।

এমন কথাই বলছেন ব্যাংক খাতের নেতৃত্ব দেয়া দক্ষ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। এদিকে গতকালও রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকে চিঠি দিয়ে পোর্টফলিও বিনিয়োগ বাড়াতে অনুরোধ করেছে বিএসইসি।

ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, একটি ব্যাংক তার রেগুলেটরি মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারবে। এর বাইরে প্রতি ব্যাংক চাইলে ২০০ কোটি টাকার বিশেষ বিনিয়োগ তহবিল গঠন ও পরিচালনা করতে পারবে। এই বিশেষ তহবিলের অর্থ পুঁজিবাজারের এক্সপোজারের মধ্যে গণনা করা হবে না। এ সুযোগ থাকবে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।

বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের কিছুটা বেশি। গত জানুয়ারি মাসে ছিল ১১ শতাংশের ওপরে। অথচ মুদ্রানীতি ও সরকারের বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে; চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হবে ১৪ দশমিক আট শতাংশ, যা এখনও বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার অনেক নিচে। আবার ব্যাংকগুলোকে তারল্য জোগানের পরিমাণ বৃদ্ধিতে সুদহারও কমিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে করে ব্যাংকগুলোর কাছে পর্যাপ্ত তারল্য রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে কোনো ব্যাংকই তার বিনিয়োগ সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করেনি। এখনও সব ব্যাংকের বিনিয়োগ করার মতো অর্থ ও সুযোগ রয়েছে।

বিষয়টি জানতে পেরেই বিএসইসির পক্ষ থেকে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসে বিএসইসি। ওই বৈঠকে বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে না ব্যাংকগুলো। এতে উপায়ান্তর না পেয়ে ব্যাংকগুলোর নামে অনুরোধপত্র পাঠায় বিএসইসি। তাতেও সাড়া না পেয়ে বিষয়টি তদারকি ও বাস্তবায়ন করতে ডিএসইকে দায়িত্ব দিয়েছে বিএসইসি।

সর্বশেষ ব্যাংকগুলোকে তাদের পোর্টফলিও বিনিয়োগের বিষয়ে জানাতে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয় বিএসইসি। কমিশন ধারণা করেছিল, এমন চিঠিতে সবাই বিনিয়োগ বাড়াবে, যদিও এমন অনুরোধ বাস্তবায়ন করতে বাধ্য নয় কোনো ব্যাংক।

সুযোগ থাকলেও কেন ব্যাংক বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে নাÑএমন প্রশ্নের উত্তরে একাধিক ব্যাংক ও মার্চেন্ট ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ‘ব্যাংককে জনগণের আমানত নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতে হয়। সেখানে বিনিয়োগের বেলায় ঝুঁকির মাত্রাও নির্ধারণ করা হয়। পুঁজিবাজারে যেমন মুনাফা বেশি, তেমনি ঝুঁকিও বেশি। এর সঙ্গে রয়েছে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য ও ভালো মানের শেয়ারের অভাবও রয়েছে। এতেই বিনিয়োগের খাত সংকুচিত হয়ে আসে; দীর্ঘমেয়াদি কোনো বিনিয়োগে যাওয়া যায় না।’

তারা বলছেন, ‘শেয়ার ট্রেডভিত্তিক বাজার ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের জন্য ভালো, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের জন্য নয়। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বড় পরিমাণে শেয়ার কেনা-বেচা করে। এতে  শেয়ারের দর হারানোর শঙ্কাই বেশি থাকে। প্রতিষ্ঠান লোকসান দিলে তো কর্মকর্তাকেই জবাবদিহি করতে হয়। নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নেও সমস্যা রয়েছে। এজন্য বর্তমানে আমাদের সমস্যা হলো আস্থার, অর্থের সংকট নয়। এর উদাহরণ হচ্ছে, গত এক বছরের আলোচিত কোম্পানির শেয়ারের দরের অস্বাভাবিক উত্থান-পতন।’

বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেয়ারে বিনিয়োগ নয়, কেনা-বেচা করেই মুনাফা তুলতে চাওয়ার প্রবণতা রয়েছে পুঁজিবাজারে। এতে বিনিয়োগকারীর চেয়ে বেশি লাভবান হয় কারসাজি চক্র, সিডিবিএল, ডিএসই ও ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান। এতে শেয়ারের দর ওঠানামা করে দ্রুত, যা প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় বিনিয়োগকারীদের এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে রাখে। বিএসইসি আবার সেই পথেই হাঁটছে। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের চেয়ে লেনদেন বাড়ানোতেই বেশি মনোযোগ।

এজন্য দর পতনের এই বাজারে আরও পতনের সুযোগ দিল গতকাল। দর পতনের সার্কিট ব্রেকার দুই শতাংশ থেকে বাড়িয়ে পাঁচ শতাংশ করা হলো। এতে করে আগের চেয়ে আরও বেশি দর পতনের সুযোগ তৈরি হলো। বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সুযোগ কোনো গোষ্ঠীকে দেয়া হচ্ছে কি না, তা দেখা দরকার।

এ বিষয়ে বিএসইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দুই শতাংশের সার্কিট ব্রেকার দেয়ায় কয়েকটি শেয়ারের দর পতনের হার নির্ধারণে কিছুটা জটিলতা দেখেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। আবার সাময়িক সময়ের জন্য দেয়া দুই শতাংশের সার্কিট ব্রেকারও বেশি দিন রাখতে চায় না। এজন্য নিয়মিত সার্কিট ব্রেকারের দিকে দ্রুত ফিরতে চাচ্ছে কমিশন। এরই অংশ হিসেবে ধাপে ধাপে সার্কিট ব্রেকারের হার বাড়ানো শুরু করেছে।

প্রথম দফায় দুই শতাংশ থেকে পাঁচ শতাংশে উন্নীত করা হলো। এর পরবর্তী ধাপে হয়তো ১০ শতাংশের সার্কিট ব্রেকারে ফিরবে। এমন আভাসই দিয়েছেন কমিশনের কর্মকর্তারা।

এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. রেজাউল করিম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘তারল্যের জোগান ও লেনদেন বৃদ্ধিতে পাঁচ শতাংশের সার্কিট ব্রেকার চালু করা হলো। আগে দুই শতাংশের বিষয়টি তো ছিল অস্থায়ী ভিত্তিতে। এর প্রয়োগের ফলাফল দেখে আবার কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে।’

কেন এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হলোÑএর উত্তরে রেজাউল করিম বলেন, ‘ফরেন পোর্টফলিও মেইনটেইন, বাজার মধ্যস্থতাকারীদেরও অনুরোধ ছিল। তারা চাচ্ছেন সার্কিট ব্রেকারের সীমার হার বৃদ্ধি করা। আশা করছি ফলপ্রসূ হবে।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মার্চেন্ট ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেছেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব বাজার তার স্বাভাবিক আচরণে ফিরুক। বাজারকে তার নিজস্ব গতিতেই চলতে দিলে ভালো হয়। একসময় বাজারই ঘুরে দাঁড়াবে। দুই শতাংশ থেকে পাঁচ শতাংশে সার্কিট ব্রেকারের সিদ্ধান্তটি অনেকেই ইতিবাচক হিসেবেই দেখবে। এতে লেনদেনের পরিমাণ আশা করি বাড়বে।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০