Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 10:30 pm

পুঁজিবাজারে লেনদেনের সঙ্গে কমেছে বিনিয়োগকারীর আয়

আতাউর রহমান: দেশের শিল্প উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নে পুঁজিবাজার শেয়ার, ডিবেঞ্চার, বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড, ট্রেজারি বিল, সার্টিফিকেট ইত্যাদি বিনিয়োগের মাধ্যমে একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। সেই সঙ্গে পুঁজিবাজারের লেনদেন দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অবদান রাখে। দেশের দুই পুঁজিবাজার ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই-সিএসই) মধ্যে ডিএসইতে চলতি বছরের জুন শেষে মোট লেনদেন আগের মাসের তুলনায় সাড়ে ২০ শতাংশ কমেছে। যেখানে সিএসইতে মোট লেনদেন আগের মাসের তুলনায় ৩২৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে জুন মাসে আগের মাসের থেকে প্রধান সূচক বৃদ্ধি পেয়েছে ডিএসইর। কিন্তু জুন মাসে সিএসইরি প্রধান সূচক মে মাসের তুলনায় কমেছে। এদিকে জুন মাসে ডিএসই ও সিএসইর উভয়ের পিই রেশিও কমেছে। সেই সঙ্গে দেশের পুঁজিবাজারের উভয় স্টক এক্সচেঞ্জে বিনিয়োগকারীর ডিভিডেন্ড ইল্ড বা আয় জুন মাসে আগের মাসের তুলনায় এবং এক বছরের তুলনায় কমেছে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেশের পুঁজিবাজার নিয়ে জুন মাসের পর্যালোচনা থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছরের জুন শেষে ডিএসইর সব সিকিউরিটিজের ইল্ড বা বিনিয়োগকারীর আয় দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৬৭। যা আগের মাস শেষে ছিল ৩ দশমিক ৬৯ এবং আগের বছরের একই সময় শেষে ছিল ৩ দশমিক ৮৮। সে হিসাবে এ বছরের জুন মাসে বিনিয়োগকারীদের আয় এক মাসর ব্যবধানে কমেছে শূন্য দশমিক ২ এবং এক বছরের তুলনায় কমেছে শূন্য দশমিক ২১। এদিকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এ আয় ধারাবাহিকভাবে কমতে শুরু করেছে। এর আগে আগের বছরের জুলাই, নভেম্বর এবং ডিসেম্বরে এ আয় সর্বোচ্চ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে চার, ৩ দশমিক ৯২ এবং ৩ দশমিক ৯৩। আর ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছিল ৩ দশমিক ৮৮। এরপর থেকেই এ ইল্ড কমতে থাকে। 

এদিকে জুন ২০২৩ শেষে ডিএসইতে লেনদেন হওয়া সিকিউরিটিজের মোট লেনদেনের মূল্য দাঁড়িয়েছে ১৪৬ দশমিক ৮০ বিলিয়ন বা প্রায় ১৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকায়। যা মে মাসের তুলনায় ২০ দশমিক ৪৯ শতাংশ কম এবং আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ১৮ দশমিক ১৭ শতাংশ কম। মে মাসে ডিএসইতে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১৮৪ দশমিক ৬২ বিলিয়ন বা ১৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকার বেশি এবং আগের বছরের জুনে লেনদেন হয়েছিল ১৭৯ দশমিক ৪০ বিলিয়ন বা ১৭ হাজার ৯০০ কোটি টাকার বেশি। সে হিসাবে এক মাসের তুলনায় লেনদেন কমেছে ৩ হাজার ৭০০ কোটি এবং এক বছরের তুলনায় লেনদেন ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা কম হয়েছে। 

বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে ফ্লোর প্রাইসের কারণে অনেক বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ নানা ফ্লোরে থাকা শেয়ারে আটকে আছে। যেসব শেয়ার ফ্লোর প্রাইস আটকে সেগুলো বেশির ভাগই অতিমূল্যায়িত। ফলে সেই শেয়ারের দাম কমতে পারছে না, আর আটকে থাকা বিনিয়োগকারীরা ক্রেতা সংকটে বিক্রিও করতে পারছে না। অপরদিকে মার্জিন ঋণ নিয়ে বিনিয়োগক করা যাদের শেয়ার ফ্লোরে আছে, তারা শেয়ার বিক্রি করতে না পারায় প্রতিদিন সুদের পরিমাণ বাড়ছে। আর বিপরীতে শেয়ারের ভ্যাল্যু কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় যাদের বিনিয়োগ আটকে আছে তারা শেয়ার বিক্রি বা নতুন করে বিনিয়োগ করতে পারছে না। ফলে লেনদেনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে শেয়ারের দাম কমে সঠিক দরে না আসা পর্যন্ত কেউ কিনবে না এবং সেটার দাম বৃদ্ধি পাবে না। ফলে শেয়ার থেকে বিনিয়োগকারীদের কোনো ক্যাপিটাল গেইন বা আয় হবে না বলে জানান তারা।  

অপরদিকে জুন শেষে ডিএসইর শরিয়াহ সূচক ডিএসইএস ১৩৭৭ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছিল, যা মে মাসের মতোই ছিল। কিন্তু আগের বছরের একই মাসের তুলনায় শূন্য দশমিক ৭১ শতাংশ কম। এ সময় ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৬ হাজার ৩৪৪ দশমিক ৯ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে, যা আগের মাসের তুলনায় শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ বেশি। কিন্তু আগের বছরের একই মাসের তুলনায় শূন্য দশমিক ৫২ শতাংশ কম। ডিএসইর বাজার মূলধন জুন শেষে ৭৭০২ দশমিক ৩২ বিলিয়ন টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা আগের মাসের তুলনায় শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ কম। কিন্তু আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ৪৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ বেশি।

চলতি বছরের জুন শেষে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজের মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৫৩টি। এর মধ্যে ৩৫৬টি কোম্পানি, ৩৬টি মিউচুয়াল ফান্ড, ২৪২টি সরকারি বন্ড, ৮টি ডিবেঞ্চার এবং ১১টি করপোরেট বন্ড ছিল। কোম্পানি সংখ্যার মধ্যে রয়েছে ৩৫টি ব্যাংক ২৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ৫৭টি বিমা কোম্পানি এবং ২৪১টি অন্যান্য কোম্পানি।

ডিএসইর বাজার মূলধনের সঙ্গে জিডিপির অনুপাত বর্তমান বাজার মূল্যে চলতি বছরের জুন শেষে ১৭ দশমিক ৩৫ শতাংশে নেমে এসেেছ। যা আগের মাস শেষে ১৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ এবং আগের বছরের একই মাস শেষে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ ছিল। এখানে উল্লেখ্য ডিএসইর বাজার মূলধনে উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে গত বছরের সেপ্টেম্বরে। সে সময় বাজার মূলধন ৫১৯৯ দশমিক ১৪ বিলিয়ন টাকা থেকে একই বছরের অক্টোবরে ৭৬৬৯ দশমিক ১৮ বিলিয়ন টাকায় পৌঁছে। সে সময় তালিকাভুক্ত সরকারি ট্রেজারি বন্ডের লেনদেন শুরু হয়, যা শেষ পর্যন্ত অক্টোবর ২০২২ থেকে জিডিপি অনুপাতে বাজার মূলধনের অংশগ্রহণ বাড়াতে সাহায্য করেছে। জুন মাস শেষে খাতভিত্তিক বাজার মূলধনের অংশগ্রহণের মধ্যে ট্রেজারি বন্ড সর্বোচ্চ অবদানকারী হিসেবে ৪০ দশমিক ৭২ শতাংশ রেকর্ড করা হয়েছে। এরপরে ওষুধ এবং রসায়নে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ, ব্যাংক ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ, টেলিযোগাযোগ ৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ, প্রকৌশলী ৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ, খাদ্য ও আনুষঙ্গিক ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ। এছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান ২ দশমিক ৪৩ শতাংশ, বিমা কোম্পানি ২ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং অন্যান্য ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। উল্লেখ্য, ডিবেঞ্চারগুলো খাতভিত্তিক বাজার মূলধনে অন্তর্ভুক্ত নয়। কারণ এই পণ্যগুলো বর্তমানে বাজারে লেনদেন হয় না।

এ সময় ডিএসইর সব সিকিউরিটিজের মূল্য আয় (পিই) অনুপাত ১৪ দশমিক ৩৪ দাঁড়িয়েছে, যা আগের মাস শেষে ১৪ দশমিক ৫০ ছিল। আর আগের বছরের জুন শেষে এ অনুপাত ছিল ১৪ দশমিক ৪৪। 

অপরদিকে ২০২৩ সালের জুন শেষে সিএসইতে তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজের মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬১৫টি। যার মোট মূলধনের পরিমাণ জুন শেষে বৃদ্ধি পেয়ে ৪১৬৬ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন টাকায় দাঁড়িয়েছে। মে শেষে যা ছিল ৪১৬২ দশমিক ১১ বিলিয়ন এবং আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ৯১০ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন টাকা। সিএসইর সার্বিক মূল্য সূচক জুন শেষে ১৮৭০২ দশমিক ২০ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছিল, যা মে মাসের তুলনায় শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ কম এবং আগের বছরের একই মাসের তুলনায় শূন্য দশমিক ১৪ শতাংশ কম। সিএসইরি শরিয়াহ সূচক আলোচ্য সময় শেষে ১১৭৫ দশমিক ৩৯ পয়েন্ট থেকে বেড়ে ১১৭৬ দশমিক ৩২ পয়েন্ট হয়েছে, যা মে মাস শেষে তুলনায় কমেছে।

এদিকে সিএসইর বাজার মূলধন জুন শেষে ৭৫৭৭ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা মে মাসের তুলনায় শূন্য দশমিক ১২ শতাংশ কম। কিন্তু আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ৭৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ বেশি। জুন শেষে সিএসইর লেনদেন করা সিকিউরিটিজের মোট লেনদেনের মূল্য মে মাসের ৩ দশমিক ২৩ বিলিয়ন থেকে বেড়ে ১৩ দশমিক ৮০ বিলিয়ন টাকায় দাঁড়িয়েছে এবং আগের বছরের ৮ দশমিক ১৩ বিলিয়ন টাকা থেকে বেড়েছে।

অপরদিকে সিএসইর সব সিকিউরিটিজের মূল্য-আয় (পিই) অনুপাত ২০২৩ সালের জুন শেষে ১৪ দশমিক ১৬ দাঁড়িয়েছিল, যা মে শেষে ছিল ১৪ দশমিক ২৭। তবে এই অনুপাত আগের বছরের জুনের শেষে ছিল ১৫ দশমিক ৬১। জুন শেষে সিএসই ইল্ড বা আয় দাঁড়িয়েছিল ৩ দশমিক ২৬, যা মে ২০২৩ এবং জুন ২০২২ শেষে যথাক্রমে ৩ দশমিক ৪৮ এবং ৩ দশমিক ৬০ ছিল।