কয়েকদিন ধরে পুঁজিবাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। কোনোমতেই পতন ঠেকানো যাচ্ছে না। পুঁজিবাজার নিজেই পড়ে যাচ্ছে না, কেউ না কেউ সেটিকে নিয়ে খেলেছে। আর সেক্ষেত্রে যতই সতর্ক থাকুন, স্বার্থান্ধ গোষ্ঠী তৎপর থাকলে বিনিয়োগকারীরা তাদের সঙ্গে পেরে উঠবেন না। কারণ সাধারণ বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগের তুলনায় খেলোয়াড়দের বিনিয়োগ হাজার গুণ বেশি, তারা ঝানুও বটে।
ক্ষতিগ্রস্ত অনেক ব্যবসায়ী বলছেন, ২০১০ সালের পর বিনিয়োগকারীদের এত বড় লোকসান আর হয়নি, যা বর্তমান ধসের কারণে হয়েছে। অনেকেই বিনিয়োগ করা পুঁজি হারিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছেন। পতন থেকে রক্ষা পাচ্ছে না শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা কোম্পানির শেয়ারও।
বাস্তবতা হলো, কঠিন সময় পার করছে দেশের অর্থনীতি। কভিড মহামারি থেকে মুক্তি পাওয়ার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ অন্যান্য কারণে বৈশ্বিক যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে দেশের অর্থনীতি কঠিন সময় পার করছে। নিত্যপণ্যের দাম নিত্যই বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। টাকার অবনমন হয়েছে, রেমিট্যান্স-প্রবাহ নি¤œগামী। মোট কথা, সামষ্টিক অর্থনীতি অনেক দিন এমন চাপে পড়েনি।
সূচকের পতন ঠেকাতে আবারও শেয়ারের দরপতনের সীমা (সার্কিট ব্রেকার) কমিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এখন থেকে তালিকাভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম এক দিনে ২ শতাংশের বেশি কমতে পারবে না। বৃহস্পতিবার থেকে সিদ্ধান্তটি কার্যকর হয়। গতকাল সূচক বাড়লেও নিয়ন্ত্রক সংস্থার আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই। দীর্ঘ মেয়াদে বাজার চাঙ্গা রাখতে একটি উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। বাজার খেলোয়াড়রা বসে থাকবে না। নতুন ফন্দি আঁটবে তারা।
সুবিধা করতে না পারলে পুঁজিবাজারের ছোট বিনিয়োগকারীরা ব্যবসা গুটিয়ে নেবেন। তা নিক কিন্তু তারা যেন সর্বস্বান্ত না হন। নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে দৃঢ়ভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, চলমান দরপতনের পেছনে যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ নেই। কার্যকারণ থাকুক বা না থাকুক, যাদের বিরুদ্ধে বাজার অস্থিতিশীল করার অভিযোগ এসেছে, প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করতে হবে।
পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থার ত্রæটিগুলোও চিহ্নিত করা জরুরি। নিয়ন্ত্রক সংস্থার তো জানার কথা, দুর্বল প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও), কোম্পানিগুলোর ত্রæটিপূর্ণ আর্থিক প্রতিবেদন, বিও হিসাবে স্বচ্ছতার ঘাটতি, সেকেন্ডারি মার্কেটে প্রশ্নবিদ্ধ লেনদেন প্রভৃতি জিইয়ে রেখে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারে না। এসব বন্ধে বিএসইসিকে কঠোর হতে হবে। গুজবে কান দেবেন না, বুঝেশুনে বিনিয়োগ করবেন; এমন পরামর্শ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো মেনে চলা উচিত। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থা যখন কোনো দুষ্টচক্রের পৃষ্ঠপোষক হয়, তখন সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করতে পারেন।
পুঁজিবাজারে লেনদেন হ্রাস-বৃদ্ধি একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এটি বিশ্বের সব বাজারেই হয়, কিন্তু তা সাময়িক। দুর্ভাগ্যজনক হলো, আমাদের দেশে প্রতিটি ‘স্বাভাবিক ঘটনা’য় শত শত বিনিয়োগকারী সর্বস্বান্ত হন। সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজারে দুষ্টচক্র সক্রিয় হয়েছে। অনেক কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারছে না। এগুলোর বিষয়ে বিনিয়োগকারীরাও জানেন। কিন্তু কারসাজি করে এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ানো হয়। বুঝে উঠতে না পেরে সেগুলোতে হামলে পড়েন বিনিয়োগকারীরা এবং ক্ষতিগ্রস্ত হন। বর্তমানে দুষ্টচক্র অনেকটা চিহ্নিত। তাদের কারসাজি বন্ধ করতে বিএসএসইকে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিতে হবে।