Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 1:49 pm

পুঁজিবাজার উত্থানে শুরু, পতনে শেষ

মো. আসাদুজ্জামান নূর: পুঁজিবাজারের ২০২১ সালের পুরোটা সময়ই ছিল উত্থান-পতনের মিশ্র প্রবণতায়। বছরের শুরুর তিন মাস ও শেষের দুই মাসের কিছু বেশি সময় পুঁজিবাজারে অস্থিতিশীলতা দেখা গেছে। অর্থাৎ এই সাড়ে পাঁচ মাস সময় বাদ দিলে বাকি সময়টা ইতিবাচক ধারায় লেনদেন করেছে দেশের পুঁজিবাজার।

ডিএসইর এক বছরের লেনদেন চিত্র বলছে, গত এক বছরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সূচক বেড়েছে এক হাজার পয়েন্টের বেশি। কিন্তু তা স্বস্তি এনে দেয়নি বিনিয়োগকারীদের। বছরের শুরুতে কভিড-১৯ মহামারির ধাক্কা ও শেষে দিকে দর সংশোধন, প্রফিট টেকিং, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মতানৈক্যের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক ও অন্যান্য বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি ইস্যুতে নেতিবাচক ছিল পুঁজিবাজার, যা বিনিয়োগকারীদের হাসি ম্লান করে দিয়েছে।

এই সময়ে অবশ্য বেশকিছু নতুন বিষয় যুক্ত হয়েছে দেশের পুঁজিবাজারে, যার প্রায় সবগুলোই বাজার ঘুরে দাঁড়াতে ইতিবাচক প্রভাব রেখেছে। এর মধ্যে রয়েছে আইপিও’র শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে প্রো-রাটা অনুসারে বরাদ্দ, কোয়ালিফাইড ইনভেস্টর অফার বাই স্মল ক্যাপিটাল কোম্পানিজ রুলস অনুমোদন, ৬টি কোম্পানি নিয়ে স্মল ক্যাপিটাল প্ল্যাটফর্মে লেনদেন চালু, ওভার দি কাউন্টার (ওটিসি) মার্কেট বিলুপ্তির মাধ্যমে ওটিসির ১৮টি কোম্পানি, ১৪টি বন্ড এবং কিছু ওপেন অ্যান্ড মিউচুয়াল ফান্ড তালিকাভুক্তির মাধ্যমে অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড (এটিবি) চালু উদ্যোগ, গভর্নমেন্ট ট্রেজারি বন্ডের পরীক্ষামূলক লেনদেন, ব্রোকারেজ হাউসগুলোকে এপিআই সংযোগের মাধ্যমে নিজস্ব ওএমএস চালুর মাধ্যমে গ্রাহক সেবার উন্নতিকরণের লক্ষ্যে দুটো ব্রোকারেজ হাউসকে ডিএসই ফিক্স সার্টিফিকেশন প্রদান, কয়েকটি দেশে রোড শো ও ৫৪টি নতুন ট্রেকের লাইসেন্স অনুমোদন।

এসব বিষয়ে ডিএসই’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিক আমিন ভূঁইয়া শেয়ার বিজকে বলেন, ‘দীর্ঘ এক দশক পর নতুন কিছু ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছে দেশের পুঁজিবাজার। অনেকগুলো কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে। নতুন প্রডাক্ট ইটিএফ চালু নতুন বছরের শুরুর দিকেই বাস্তবায়িত হবে। নতুন বছরের প্রথমার্ধেই আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আনার চেষ্টা করব।’

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, আগের বছর ও চলতি বছরের শেষ কার্যদিবসের মধ্যকার সময়ের ব্যবধানে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স বেড়েছে এক হাজার ৩৫৪ পয়েন্ট। ২০২০ সালের শেষ কার্যদিবসে প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্সের অবস্থান ছিল পাঁচ হাজার ৪০২ পয়েন্ট। গতকাল শেষ হওয়া ২০২১ সালের কর্মদিবসে সূচকের অবস্থান দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার ৭৫৬ পয়েন্ট। অবশ্য বছরের মধ্যবর্তী সময়ে সূচক উঠেছিল সাত হাজার ৩৬৭।

বছরজুড়ে সূচকের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, জানুয়ারির শুরুতে সূচকের অবস্থান ছিল পাঁচ হাজারের ঘরে। এ সময় লেনদেন ছিল দুই হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। এরপর সূচক বেড়ে ৩০ জুনে তা ছয় হাজারের ঘর অতিক্রম করে। সূচকের অবস্থান হয় ছয় হাজার ৮ পয়েন্ট। লেনদেন দুই হাজার কোটি ছাড়িয়ে যায়।

সূচক বাড়া-কমার মধ্য দিয়ে ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে। ৫ সেপ্টেম্বরে সেটি সাত হাজার ৫২ পয়েন্টে চলে যায়। লেনদেন ছাড়ায় দুই হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে লেনদেনে কিছুটা ভাটা পড়ে। ২০ সেপ্টেম্বর সেটি চলে আসে দুই হাজার কোটি টাকার নিচে।

পরের দিকে আরও খারাপ হতে থাকে পুঁজিবাজারের সার্বিক অবস্থা। সূচক ও লেনদেন উভয়ই হ্রাস পেতে থাকে। নভেম্বরের প্রথম দিন সূচক সাত হাজারের নিচে চলে আসে। কিছুদিন পরে ১৬ নভেম্বর সূচক আবার সাত হাজার অতিক্রম করলেও তা স্থায়ী হয়নি। ২৪ নভেম্বর নেমে যায় ছয় হাজার ৯১৭ পয়েন্টে। এর এক দিন পর সর্বপ্রথম লেনদেনে এক হাজার কোটি টাকার নিচে নেমে যায়। ৭ ডিসেম্বর একবার সূচকের অবস্থান সাত হাজারের ওপরে গেলেও ধারাবাহিক পতনে গতকাল পর্যন্ত ছয় হাজার ৭৫৬ পয়েন্টে স্থির হতে দেখা যায়। তবে লেনদেন আর এক কোটি টাকার ঘর অতিক্রম করতে পারেনি।

মোটা দাগে বলা যায়, ২০২০ সালের মাঝামাঝিতে শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের নেতৃত্বে বিএসইসির নতুন কমিশন গঠনের পর থেকে ২০২০ সালের ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত এক দফা এবং ওই বছরের ৪ এপ্রিল থেকে ৩০ মে পর্যন্ত দ্বিতীয় দফা, এরপর ১ জুলাই থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তৃতীয় দফা উত্থানে সূচক সাত হাজার পয়েন্ট ছাড়িয়ে যায়। যদিও বিএসইসির বর্তমান চেয়ারম্যান সূচক ১০ হাজার ছাড়িয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রধান সূচক উত্থানের পর সাড়ে ছয় হাজারের কাছেই ঘোরপাক খাচ্ছে।

২০১০ সালের মহাধসের পর এই প্রথম বাজারে দেখা দেয় আলোড়ন। হাজার হাজার বিনিয়োগকারী বছরের পর বছর লোকসানি বিও হিসাবগুলো কিছুটা মুনাফার মুখ দেখেন। এক দশকের সবচেয়ে বেশি লেনদেন ও ১১ বছরের সর্বোচ্চ সূচকও দেখেছেন বিনিয়োগকারীরা। লেনদেন পৌনে তিন হাজার কোটি টাকা ছুঁয়ে ফেলার পর তা পাঁচ হাজার কোটি টাকা ছাড়াবেÑএমন আশাবাদ করা হয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির পক্ষ থেকে।

কিন্তু এরপর থেকেই দেখা দেয় উল্টোচিত্র। অর্থবছরের শেষ তিন মাসে, সুনির্দিষ্টভাবে বললে গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া দর সংশোধনের এক মাস পর পতনে শেয়ারদর, সূচক, লেনদেনের নি¤œমুখিতা হতাশা ছড়িয়েছে।

এর মধ্যে ২০২১ সালে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির দ্বন্দ্বের বিষয়টি। গত ৩০ নভেম্বর ও পরে ৭ ডিসেম্বর দুই পক্ষে দুইবার বৈঠকেও ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা গণনা বা এক্সপোজার লিমিটের গণনা বাজারমূল্যের বদলে ক্রয়মূল্যে হবে কি না, তা নিয়ে সিদ্ধান্তে আসা যায়নি। বন্ডে বিনিয়োগ ব্যাংকের বিনিয়োগসীমার বাইরে রাখতে বিএসইসির অনুরোধ রাখেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এদিকে ২০২১ সালে ১টি সুকুক বন্ড ও ১৪টি কোম্পানিসহ মোট ১৫টি কোম্পানি বাজার থেকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর মাধ্যমে এক হাজার ৬৫৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা মূলধন সংগ্রহ করে। এছাড়া ৪টি প্রতিষ্ঠান বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে ২০০ কোটি টাকা মূলধন সংগ্রহ করে। ২০২১ সালে ডিএসই’র বাজার মূলধন ২০২০ সালের তুলনায় ৯৩ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়। অবশ্য সর্বোচ্চ বাজার মূলধন উঠেছিল পাঁচ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকা।