পুঁজিবাজার উন্নয়নে প্রতিবন্ধক সঞ্চয়পত্র

সঞ্চয়পত্র থেকে লাগামহীন ঋণ নিচ্ছে সরকার। এ প্রবণতা ঝুঁকি ও বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করছে অর্থনীতিতে, নিয়মিতই যার সমালোচনা করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারপরও সরকার এ বিষয়ে নীতিনির্ধারণী কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। সঞ্চয়পত্র থেকে ঢালাও ঋণ নেওয়া এবং অর্থনীতিতে এর সম্ভাব্য প্রভাব বিশ্লেষণ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন তথ্য নিয়ে অনুসন্ধান করেছে শেয়ার বিজ। এ নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ ছাপা হচ্ছে তৃতীয় পর্ব

শেখ আবু তালেব: পুঁজিবাজারকে যে কোনো দেশের অর্থনীতির আয়না হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর চিত্র থেকেই অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। বাংলাদেশের পুঁজিবাজার উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি অনেক উদ্যোগ নেওয়া হলেও ফল প্রায় শূন্যের ঘরে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমফ) এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, উচ্চ সুদে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার ঋণ নেওয়ায় পুঁজিবাজার উন্নয়ন, সরকারি বন্ড ও সেকেন্ডারি মার্কেট উন্নয়নে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন, পুঁজিবাজার উন্নয়নের সঙ্গে আর্থিক শৃঙ্খলা রক্ষায় সুদহার কমানোর পাশাপাশি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর জন্য নির্ধারণ করতে হবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি।
উচ্চ সুদে জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ায় অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব নিয়ে আইএমএফের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সংস্থাটির মতে, সঞ্চয়পত্র থেকে বেশি ঋণ নেওয়ায় প্রত্যাশিত উন্নয়ন হয়নি সরকারি সিকিউরিটিজ মার্কেট ও অন্যান্য আর্থিক বাজারের। বৃদ্ধি পেয়েছে সরকারের সুদ ব্যয়। বাংলাদেশের আর্থিক বাজার বলতে সরকারি সেকেন্ডারি সিকিউরিটিজ ও বন্ড মার্কেট এবং পুঁজিবাজারকে বোঝায়।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, সুদহার বেশি হওয়ায় মানুষ সব টাকা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে শুরু করেছে। এতে পুঁজিবাজারে অর্থের সরবরাহ কমে যায়। দীর্ঘ মেয়াদে পুঁজিবাজারের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। আর্থিক শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে সরকারের উচিত সঞ্চয়পত্রে সুদহার কমিয়ে আনা। নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকেও এ খাতে বিনিয়োগের সুবিধা দেওয়া। বিশ্বের অনেক দেশই সঞ্চয়পত্র বন্ধ করে দিচ্ছে। সরকারকেও ধীরে ধীরে এ প্রক্রিয়ায় যাওয়া দরকার।
জানা গেছে, ২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সংকট শুরু হওয়ায় বিনিয়োগ কমিয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। ফলে ২০১২-১৩ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়ে যায়। পরের বছর স্বাভাবিক থাকলেও ২০১৪-১৫ অর্থবছরের মধ্যবর্তী সময় থেকে সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ বেড়ে যায় অস্বাভাবিক হারে। সে সময় সরকারও ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেওয়ার জন্য বাজেটের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। ফলে ব্যাংকগুলোয় অলস অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। মুনাফা ধরে রাখতে ব্যাংকগুলো আমানতের ওপর সুদহার কমিয়ে দেয়। তখনও সঞ্চয়পত্রে সুদহার ১৪ শতাংশ পর্যন্ত ছিল।
২০১২-১৩ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ ছিল ৭৭০ কোটি টাকা। পাঁচ বছর পর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬৭ গুন বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৫১ হাজার ৬০০ কোটিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (২০১৭ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত) বিক্রি হয়েছে ৬৬ হাজার ৬৬২ কোটি ৫০ লাখ টাকার। এ সময় সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে মোট ৪০ হাজার ৮৭০ কোটি দুই লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে নিয়েছে মাত্র ৮৭০ কোটি টাকা। বাকি ৪০ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে সঞ্চয়পত্র থেকে। অর্থাৎ এ সময় শেষে সঞ্চয়পত্র থেকে অর্থ ধার নেওয়ার নিট স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা।
অথচ জাতীয় বাজেটে চলতি অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৬০ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল সরকারের। এর মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে ২৮ হাজার ২০৩ কোটি ও ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে ৩২ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার কথা ছিল। অভ্যন্তরীণ খাত থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার হার গত বছরের তুলনায ২৪ দশমিক ৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও এর প্রায় পুরোটাই সঞ্চয়পত্র থেকে নেওয়া।
আলোচিত সময়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্যমতে, ২০১৩-১৪ অর্থবছর শেষে ডিএসই’র বাজার মূলধন ছিল দুই লাখ ৯৪ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। এক বছর পরই ২০১৪-১৫ অর্থবছর শেষে তা দাঁড়ায় তিন লাখ ২৪ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে বাজার মূলধন হয় তিন লাখ ১৮ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানেই বাজার মূলধন কমে যায় ছয় হাজার ১৫৫ কোটি টাকায়।
জানা গেছে, সেকেন্ডারি সিকিউরিটিজ মার্কেট হিসেবে কম সুদে ট্রেজারি বন্ড ও ট্রেজারি বিল নিলামের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে সরকার। সঞ্চয়পত্র বিক্রির চাপে এক পর্যায়ে ওই সময় ট্রেজারি বিল ও বন্ড নিলাম বাতিল করে দিতে হয় সরকারকে। ফলে এ খাত বিকাশেও প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। কয়েক বছর বন্ধ থাকার পর সে নিলাম আবার চালু হয়েছে।
প্রসঙ্গত, সামাজিক নিরাপত্তার অংশ হিসেবে বিশেষ কিছু জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সুবিধা দিতে ব্যাংকের চেয়ে উচ্চ সুদে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সুবিধা দেওয়া হয়। এছাড়া সরকারের ঋণের একটি উৎস হচ্ছে সঞ্চয়পত্র। বয়োজ্যেষ্ঠ, প্রতিবন্ধী ও অবসরে যাওয়া ব্যক্তিরা এর অন্তর্ভুক্ত। এজন্য ব্যক্তিগতভাবে একজনের সর্বোচ্চ বিনিয়োগসীমা ৩০ থেকে ৫০ লাখ টাকা ও পারিবারিকভাবে সর্বোচ্চ ৬০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে পারবে সঞ্চয়পত্রে।
ব্যক্তি ও পারিবারিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সীমা নির্ধারিত থাকলেও প্রতি বছর কী পরিমাণ সঞ্চয়পত্র বিক্রি করা হবে, তার কোনো সীমা নেই। ফলে কেউ চাইলেই এ খাতে বিনিয়োগ করতে পারেন। লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত না থাকায় চাহিদা মোতাবেক বিক্রি হয় সঞ্চয়পত্র। এজন্য ছয় বছর ধরে বেড়েই চলেছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও সরকারের এ খাত থেকে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০