অনাথ শিশুর মতো যার জীবনখানি নিস্তরঙ্গে নিথর হতে পারতো নিযুত জীবনের নিঠুর নিয়তিপাশে তিনি জুগিয়েছেন হৃৎস্পন্দনের খোরাক। দেশের জন্য লড়েছেন। শূন্য জমিনে গড়েছেন ব্যবসায় কাঠামো। জীবনের সব অর্জন লিখে দিয়েছেন মানুষের নামে। তিনিই দেশের সবচেয়ে সফল ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’-এর জনক রণদা প্রসাদ সাহা। নারীশিক্ষা ও চিকিৎসায় নারী-পুরুষ কিংবা ধনী-গরিবের ভেদ ভেঙেছেন। তার জীবনেই রয়েছে সসীমকে ডিঙিয়ে অসীমে শক্তি সঞ্চারের কথামালা। এ জীবন ও কেতন যেন রোমাঞ্চিত হৃদয়েরই উদ্দীপ্ত প্রেরণা। পর্ব-৪১..
মিজানুর রহমান শেলী: বিনিয়োগ করার মতো ব্যক্তিগত সম্পদ বা পুঁজি সংকট উতরানোর পর ব্যবসায় পদার্পণ বা প্রবেশটা হয় সহজসাধ্য। কিন্তু নতুন নতুন সংকট পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে তৈরি হতেই থাকে। পণ্য বাজারজাতকরণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ এটি বহুমুখী। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বাজার প্রতিযোগিতা। তবে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে ব্যবসা-বাণিজ্যের এক বড় সংকট হলো নিরাপত্তা। সম্পদ-সম্পত্তি বা জীবন সব ধরনের নিরাপত্তাই এখানে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। রণদা প্রসাদ সাহার ব্যবসায়িক পরিমণ্ডলে এসব ধরনের ঝুঁকিই সক্রিয় ছিল।
বিনিয়োগ করার মতো ব্যক্তিগত সম্পদ: সুন হুন লি-এর গবেষণায় দেখ গেছে, পৃথিবীর সব দেশেই গ্রামাঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ অর্থ সঞ্চয় করে না। বরং তারা যা আয় করে তার প্রায় পুরোটাই খরচ করে, যা হাতে থাকে তা দিয়ে ব্যবসায়িক উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয় না। একজন উদ্যোক্তাকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পাশাপাশি হাতে নগদ অর্থ থাকাটাও জরুরি। কেননা নগদ অর্থই হলো ব্যবসার প্রধান চাবিকাঠি। এই অর্থ প্রাথমিকভাবে পণ্যের মান ও উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নয়নে উপকরণাদি ও আনুষঙ্গিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে প্রয়োজন হয়। ব্রিজেশ ও ক্রিত ভারতের অনুন্নয়নশীল অঞ্চলের গ্রাম পরিবেশে বাণিজ্যিক উদ্যোগের ক্ষেত্রে আর্থিক সংকটের তিনটি রূপ চিত্রায়ণ করেছেন
এক. আর্থিক টানাপড়েন, দুই. অবকাঠামো অসুবিধা , তিন. ঝুঁকির ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষাকারী অনুষঙ্গের অভাব।
আর্থিক সংকটের এই তিনটি প্রভাবকের সবগুলোই রণদা প্রসাদ সাহাকে অতিক্রম করতে হয়েছে। রণদার বিনিয়োগ করার মতো ব্যক্তিগত সম্পদ ছিল খুবই সামান্য। এই সামান্য পুঁজির মধ্য থেকেই তাকে অবকাঠামো নির্মাণ, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাসহ সব খরচ সামলাতে হয়েছে। ইংরেজদের একেকটি কোম্পানির পরিধি ছিল বিশাল। তারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অসংখ্য নৌযান পরিচালনা করেছে। এক জায়গায় লোকসান গেলেও আরেক জায়গার লভ্যাংশে ঝুঁকি ভারসাম্য করেছে। এমনকি লগ্নির পাশাপাশি ঋণ পাওয়ার সুযোগও ছিল অন্যদের বেশি। রণদার মতো সামান্য পুঁজির একজন ব্যবসায়ীর কেউ ঋণ দিতে আগ্রহী হয়নি। সামান্য লগ্নির মধ্যেই তাকে কয়লা ও লঞ্চ ব্যবসার অবকাঠামো সংকট দূর করতে হয়েছে। এমনকি ভারসাম্য রক্ষার কোনো সুযোগ নিশ্চিত না করেই তাকে লঞ্চের ব্যবসায় নামতে হয়েছে।
প্রতিযোগিতা ও বাজারজাতকরণ: পুঁজি সংকটের ফলে সৃষ্ট সংকট দূরীকরণে তিনি বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ব্যবহারিক জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বাজারজাতকরণে কিছু কৌশল প্রয়োগ করেন। কার্যত, বাজার ব্যবস্থায় টিকে থাকতে গিয়ে বিপণন ব্যবস্থায়ও সৃজনী পদক্ষেপ নিতে হলো রণদাকে। বলতে হয় এ কাজটি তিনি নিপুণমনে আর যাপিত জীবনের স্বাচ্ছন্দ্যকে এড়িয়ে গিয়ে সমাধা করেছিলেন। বাজারজাতকরণে তিনি কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। এ পদক্ষেপগুলোকে আধুনিক বাজারজাতকরণের তত্তের বিচারে বাস্তবভিত্তিক ও বিজ্ঞানসম্মত বলতে হয়। পিটার ফিস্ক বাজারজাতকরণের কৌশল বিচারে তিনটি ধাপের কথা উল্লেখ করেছেন। ফিস্কের ধারণা থেকে এ তিন ধাপে প্রতিযোগিতার স্থান, প্রক্রিয়া ও জয়ী হওয়ার কৌশল উল্লেখ করা হয়েছে এখানে ছবি বসবে রণদার ব্যবসার প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান ছিল না, তবুও যে বিজ্ঞানসম্মত পদক্ষেপ তিনি নিয়েছিলেন তা ফিস্ক পিটারের এ তিনটি ধাপের সঙ্গে মেলানো যায়।
এক. বিপণনের স্থান: তিনি প্রথমে শোভাবাজারের আশেপাশে ফেরি করে কয়লা বিক্রি করতেন। কিন্তু খেয়াল করলেন এভাবে, তিনি বড় ব্যবসা করতে পারবেন না। তাকে অবশ্যই গৃহস্থালির কয়লা সরবরাহের বাইরে মিল-কারখানায় কয়লা সরবরাহ করতে হবে। সেখানে বেশি সরবরাহ, বেশি মুনাফা। ফেরি ব্যবসার অনিশ্চয়তা এবং অধিক শ্রমের বিপরীতে তা হবে সুবিধাজনক। তখন থেকেই তিনি বিভিন্ন মাধ্যম দিয়ে কারখানায় কয়লা দেওয়ার সুযোগ ও সহযোগিতা অনুসন্ধান শুরু করেন। বঙ্গশ্রী কটন মিলের মালিক জমিদার সতীশ বাবুর সঙ্গে চুক্তিতে আসতে সক্ষম হন।
দুই. বিপণনে নিজকে নিয়োগ দান: বিপণন সংশ্লিষ্ট সাহিত্য, প্রবন্ধ, গ্রন্থ অধ্যয়ন হয়েছে ঢের; তাতে বোঝা গেল গত শতকের ৯০-এর দশকের পর থেকে বিপণন নিয়ে চিন্তাভাবনায় বিশাল এক আন্দোলন বয়ে গেছে। এ আন্দোলনে বিপণনকে যতটা ফাংশন হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছেÑতার চেয়ে ঢের বেশি মূল্যবোধ ও কর্মপ্রণালি হিসেবে। বিষয়টি এমন, যেন সমূহ ফাংশন কেবল বাস্তবায়নের মাঝে সফলতা পায়। এই দৃষ্টিতে বিপণন প্রাত্যহিক কাজে পরিণত হয়েছে: যেন তা কার্যকরীভাবে বিপণনসংশ্লিষ্ট ফাংশনের প্রভাবকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়, কিন্তু বিপণনের প্রভাবকে শক্তিশালী করে তোলে। ম্যাক কেন্নার মতে, বিপণনই সব আবার যেন সবকিছুই বিপণন; অথবা হেকেল বলেছেন, বিপণনের ভবিষ্যৎ কোনো একটি ব্যবসায়িক ফাংশন নয়, বরং ব্যবসায়িক ফাংশন বলতে যা কিছু আছে তা-ই হলো বিপণনের ভবিষ্যৎ। বিপণনের এই গুরুত্ব রণদা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বোঝার সুযোগ কখনও পায়নি। তবে তিনি আপনা থেকেই দেশ-বিদেশের রোমাঞ্চকর সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা আর সৃজনী শক্তিমত্তা দিয়ে কুড়িয়ে নিয়েছিলেন।
বিপণন কীভাবে করবেন অর্থাৎ সীমিত পুঁজি আর লোকবলের মধ্যে কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করা ছিল তার একটি চ্যালেঞ্জ। তা তিনি বুঝে নিয়েছিলেন। তাই সব কষ্টভার নিজ গতরে তুলে নিয়ে অহর্নিশি ছুটে চলেছেন। বিপণন কাজে প্রথমে তিনি নিজেই অংশ নিয়েছেন। পরে যখন তার ব্যবসার পরিধি বেড়ে গেল, তখন তিনি তার বড় ভাইকে নিযুক্ত করলেন। তিনি তার ভাইকেও বেতন দিয়েছেন। বাইরের কাউকে তিনি বেতন দিয়ে রাখতে পারতেন। কিন্তু এটা ছিল বিপণন কাজে বিশ্বস্ততার কৌশল। এটাকে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার মাঝেও চিন্তা করতে হবে। ছুটে চলার এই ক্ষণে সৃজনী মন পরিকল্পনা আঁটতে ভোলেনি।
তিন. আগাম প্রদত্ত অর্থে কয়লা সরবরাহ: যখন তিনি দেখলেন তার পুঁজি কম আবার বড় চালান ছাড়া ব্যবসা বাড়ানো যাচ্ছে না, তখনই তিনি জমিদার সতীশ বাবুর কাছ থেকে আগাম অর্থ নিয়ে, সেই অর্থে কয়লা কিনে তার মিলেই সরবরাহ শুরু করলেন। তিনি এখানে একজন মধ্যস্বত্বভোগীর ভ‚মিকা নিলেন। এতে তার পুঁজি গঠন, বড় চালানের পরিচিতি, অন্য কারখানার সঙ্গে চুক্তিতে আসার সুযোগ তৈরি হয়ে গেল। এভাবেই তিনি প্রাথমিক সংকট জয় করলেন।
নিরাপত্তা: যেখানে জীবন ও সম্পদের কোনো নিরাপত্তা নেই, সেখানে কোনো ব্যবসা ঠাঁই করে নিতে পারে না। সম্পদের নিরাপত্তা বলতে এমন এক অবস্থাকে বোঝানো হয় যখন সমূহ তথ্য, উপকরণ, কর্মকর্তা-কর্মচারী, কার্যক্রম ও স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিভিন্ন ধরনের গুপ্তচরবৃত্তি, অন্তর্ঘাত, পরাভব, চরমপন্থা, সন্ত্রাস ও অপরাধ থেকে নিরাপদ থাকে। তবে বিংশ শতকের শুরুর দিকে কলকাতায় আইন-শৃঙ্খলার অবস্থা খুব বেশি খারাপ ছিল না। দিনদুপুরে মালামাল লুটপাট হয়ে যাওয়ার মতো শঙ্কাও মোটা দাগে ছিল না। মানুষে মানুষে হƒদ্যতা, সহমর্মিতা আর সহযোগিতার সম্পর্ক আজকের থেকে অনেক প্রাণপূর্ণ ছিল। তাছাড়া খুন-খারাবি কিংবা মাস্তানি, রাহাজানি, সন্ত্রাসী আজকের দিনের মতো এতটা প্রকট রূপ লাভ করেনি। তবে ব্যবসায় সমাজের মাঝে প্রতারণা আর ঠগবাজি কিন্তু ছিল। তাছাড়া একজন প্রান্তিক মানুষের জন্য একটি উদ্যোগ গ্রহণ করাটা ছিল আর্থ-সামাজিক অভ্যাস, পুঁজি, প্রশিক্ষণগত দৈন্যতায় নিতান্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
এ সময়ে রণদা কোনো ধরনের ক্ষতি, হয়রানি বা প্রতারণার শিকার হয়েছিলেন কি না, এমন তথ্য পাওয়া যায়নি। তাছাড়া তিনি ব্যবসায় উদ্যোগে কতটুকু নিরাপত্তা বোধ করতেন বা তার কোনো শঙ্কা ছিল কি না, তাও জানা যায়নি।
গবেষক, শেয়ার বিজ
mshelleyjuÑgmail.com